পাটিগণিতের হিসাবে যে অঙ্ক নিমেষে মিলিয়ে দেওয়া যায়, রাজনীতির পাঠ্যক্রমে তা-ই দুস্তর। প্রতীকী ছবি।
আপাত ভাবে, বিরোধী দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটি সহজ— যার যেখানে যতটুকু শক্তি, সব একত্র করে বিজেপির বিরুদ্ধে ২০২৪-এর লড়াইয়ে নামা। কিন্তু, পাটিগণিতের হিসাবে যে অঙ্ক নিমেষে মিলিয়ে দেওয়া যায়, রাজনীতির পাঠ্যক্রমে তা-ই দুস্তর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা বিষয়ে আস্থা প্রকাশ করার পরও অমর্ত্য সেন যে কথাটি বলেছেন, তাতে এই দুস্তর বাস্তবেরই প্রতিফলন। শ্রীসেনের মতে, বিজেপির বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া ক্ষোভকে মমতা কতখানি এককাট্টা করতে পারেন, তা দেখতে হবে। কথাটির দ্বিবিধ অর্থ হওয়া সম্ভব। এক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল শক্তি যেখানে, সেই পশ্চিমবঙ্গে তিনি বিজেপির বিভেদকামী রাজনীতির কতখানি বিরোধিতা করতে পারেন, তা এখনও সংশয়াতীত নয়। দুই, সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী জোট তৈরির ক্ষেত্রে মমতার আন্তরিকতা এখনও প্রমাণিত নয়। দু’টি অর্থেই শ্রীসেনের কথাটি সত্য। তবে, শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই নন, এই প্রশ্ন দু’টি আরও অনেক আঞ্চলিক দলের ক্ষেত্রেই সমান ভাবে প্রযোজ্য। সিপিএম যেমন। কংগ্রেসের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-য় যোগ দেবে কি না, সেই দোলাচলেই যাত্রা শেষ হওয়ার উপক্রম। আম আদমি পার্টি আবার বিজেপির ‘বিরোধিতা’ করতে নেমে নিজেদেরই হিন্দুত্বের রাজনীতির বিকল্প সওদাগর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত। সর্বভারতীয় জোটে হীনবল কংগ্রেসের গুরুত্ব স্বীকার করতেও আঞ্চলিক দলগুলির আপত্তি স্পষ্ট। ফলে, পাটিগণিতের হিসাবে যে জোট সম্ভব ও যার সাফল্যের সম্ভাবনা যথেষ্ট, প্রকৃত রাজনীতির ময়দানে তা ক্রমেই অলীক হতে বসেছে।
বিরোধী দলগুলির অধিকাংশেরই দ্বিধার পিছনে দ্বিবিধ কারণ। প্রথমত, আঞ্চলিক রাজনীতি ও সর্বভারতীয় রাজনীতিতে দলগুলির স্বার্থ সর্বদা সমানুবর্তী নয়। তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে প্রবল শক্তিধর, এই রাজ্যে ক্ষীণবল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সিপিএমের সঙ্গে বৈরীর ভাষ্য বজায় রাখা রাজনৈতিক কারণেই প্রয়োজন, কেননা শুধুমাত্র সেই বিরোধিতাই দলটিকে ক্ষমতায় এনেছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপি এখনও তত বড় রাজনৈতিক শক্তি নয়, যার বিরোধিতায় যাবতীয় অতীত বিস্মৃত হয়ে জোটকল্পনা সম্ভব। এবং এ-যাবৎ কাল যত ভাবে বিজেপি-বিরোধী সর্বভারতীয় জোট তৈরির চেষ্টা হয়েছে, তত বারই তৃণমূলের ভূমিকা তার পরিপন্থী থেকেছে। সিপিএমের পক্ষেও তাদের একমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্র কেরলের রাজনৈতিক সমীকরণ ভুলে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা মুশকিল। গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচন প্রমাণ করেছে, বিজেপি-বিরোধিতার চেয়ে আম আদমি পার্টির কাছে বড় লক্ষ্য হয়েছিল কংগ্রেসের ভোট কাটা। নীতীশ কুমারকে আদৌ বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির অংশ বলা চলে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কার্যত প্রতিটি দলই অন্য দলের বিরুদ্ধে কোনও না কোনও সময় ‘বিজেপির সঙ্গে সেটিং’-এর অভিযোগ তুলেছে। তার সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা না করেও বলা যায় যে, এখনও অবধি সৎ জোট-প্রচেষ্টা চোখে পড়েনি।
দ্বিধার দ্বিতীয় কারণ, আঞ্চলিক নেতাদের সর্বভারতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ফলে, পরের যাত্রাভঙ্গ করার প্রবণতাটি বিলক্ষণ রয়েছে। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্ব মানতে শরিক দলগুলির দ্বিধা ছিল না, কারণ স্বাভাবিক সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সেই গৌরব হৃত— ভারত জোড়ো যাত্রাও তাকে পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। ফলে, কার নেতৃত্বে জোট হবে, জোট থেকে কোন দলের ভাগে লাভের কতখানি আসবে, এই বিবিধ ভগ্নাংশ-ত্রৈরাশিকে জোট-সম্ভাবনা ক্ষীয়মাণ। ক্ষুদ্র স্বার্থের উপাসনা ত্যাগ করা রাজনীতির পক্ষে কঠিন। কিন্তু বিরোধী স্বপ্ন বাস্তব করতে হলে কঠিন পথটিই একমাত্র পথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy