জিশুর জন্মের দৃশ্যের এই প্রদর্শনী (নেটিভিটি সিন) কত না প্রজন্মের কাছে এক প্রাচীন কাহিনিকে জীবন্ত করে তুলেছে। ফাইল চিত্র।
অতি দীন এক পশুশালায় দরিদ্র পিতামাতার শিশুর জন্মের দৃশ্য আজ প্রদর্শিত হচ্ছে সর্বত্র, বৈভবশালী গির্জায়, অতিকায় শপিং মলে, অভিজাত হোটেল-রেস্তরাঁয়, গৃহস্থের বৈঠকখানায়। গরু-ঘোড়াকে খাবার দেওয়ার পাত্রে শুয়ে এক নবজাতক, পাশে নতমস্তক জোসেফ-মেরি, উটের পিঠে মহার্ঘ উপহার বয়ে আনা তিন প্রাজ্ঞ পুরুষ, মেষপালকেরা, সবার উপরে উদ্ভাসিত বেথলেহেম-এর সেই অলৌকিক তারা। জিশুর জন্মের দৃশ্যের এই প্রদর্শনী (নেটিভিটি সিন) কত না প্রজন্মের কাছে এক প্রাচীন কাহিনিকে জীবন্ত করে তুলেছে। ইতিহাস অবশ্য বলে, জিশুর জন্মের বারোশো বছর পরে ইটালির একটি ছোট গ্রামে প্রথম দেখা গিয়েছিল এই প্রদর্শনী। তৎকালীন পোপের অনুমতি নিয়ে সন্ত ফ্রান্সিস এই দৃশ্যের নির্মাণ করেছিলেন, মানুষকে জাগতিক ঐশ্বর্য থেকে ফিরিয়ে আত্মিক সম্পদের দিকে আকর্ষণের উদ্দেশ্যে। সেখানে মানুষ অভিনেতাদের সঙ্গে ছিল জীবন্ত পশুও— একটি গাধা ও একটি ষাঁড়। ১২২৩ সালের সেই প্রদর্শনী এমনই জনপ্রিয় হয় যে, তা ছড়িয়ে পড়ে নানা নগরে, নানা দেশে। ক্রমে অভিনেতাদের স্থান নেয় মূর্তি। অথচ, পশুদের উপস্থিতির উল্লেখ নাকি সপ্তম শতকের আগে কোনও লিখিত নথিতে পাওয়াই যায় না। জন্মের দৃশ্যের প্রথম দু’টি বিবরণও অবশ্য লিপিবদ্ধ হয়েছিল জিশুর মৃত্যুর কয়েক দশক পার করে, সন্ত লুক আর সন্ত ম্যাথিউয়ের শুভবার্তায়। তার পর নানা যুগে, নানা দেশে, মানুষ তার মনের মাধুরী মিশিয়ে চলেছে খ্রিস্টের জন্মের দৃশ্যকল্পে। মেষপালকদের পিছু পিছু এসেছে ভেড়ারা, শান্তির প্রতীক সাদা পায়রাও উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তা নিয়ে কেউ কথা তোলেনি।
আপত্তি উঠেছিল কুকুর নিয়ে, ২০১১ সালে। আমেরিকার সবচেয়ে বড় আর জাঁকালো ক্যাথলিক আরাধনা স্থলগুলির অন্যতম নিউ ইয়র্কের সেন্ট প্যাট্রিকস ক্যাথিড্রালের নেটিভিটি দৃশ্যে যখন এক ল্যাব্রাডর কুকুরের আগমন ঘটে, তখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, এ কি অনধিকার প্রবেশ নয়? জিশুর পাশে ল্যাব্রাডর আসে কী করে? অন্য দিকে, কুকুরপ্রেমীরা দাবি করেছিলেন, এটাই তো স্বাভাবিক। মেষপালকেরা যদি ভেড়া নিয়ে এসে থাকে শিশুকে দেখতে, ভেড়া খেদাবার কুকুর কি আর তাদের সঙ্গে আসেনি? সভ্যতার আদি কাল থেকেই মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী কুকুর, অতএব বেথলেহেম-এ কুকুর ছিল না, এমন হতে পারে না। যিনি সবাইকে অকাতরে প্রেম বিলিয়েছেন, সেই জিশু কখনও দূরে সরিয়ে রাখতেন না মানুষের প্রিয়তম বন্ধুকে। প্রদর্শনীতে কুকুরের আবির্ভাবের অন্তরালের গল্পটি অবশ্য নেহাতই ছাপোষা, ওই ক্যাথিড্রালের এক যাজক তাঁর প্রিয় পোষ্যের আদলে তৈরি কাঠের মূর্তিকে স্থান করে দেন বেথলেহেম-এর গোয়ালঘরে। এগারো বছর পার করে এ বছরও সে সসম্মানে বর্তমান। রোম, অ্যাসিসি-সহ বহু শহরে উট, গাধা, ষাঁড়ের পাশাপাশি অন্যান্য পোষ্যের প্রতিকৃতি মেলে। যারা মানুষের জীবনে আছে, তারা মানবপুত্রের অভ্যর্থনাতেও উপস্থিত হয়েছে। প্রাচীন গ্রন্থের সাক্ষ্যের সঙ্গে সমকালীন আবেগের সংঘাত বার বার ঘটেছে। কেউ তাতে বিচলিত হন, কেউ তেমন হন না।
দৈবজীবনের এমন প্রসার ভারতীয়দের অবশ্য অতি পরিচিত। ঝুলনে রাধাকৃষ্ণের মূর্তির চার পাশে কী না স্থান পায়। খেলনা মোটরগাড়ি থেকে খুদে ক্যাঙারু, সবই জায়গা করে নেয় বৃন্দাবনের লীলাভূমিতে। দেবতাকে যদি পরমাত্মীয় বলে গ্রহণ করতে হয়, তবে সেই রসের খেলার সঙ্গী হয়ে পরমেশ্বরকেও ভক্তের আনন্দকে আস্বাদন করতে হয়। তাই ভক্তের প্রিয় খাবার হয় ঈশ্বরের ভোগ, তার প্রিয় গান হয় ঈশ্বরের বন্দনা, প্রিয় সঙ্গীও হয় দেবতার সঙ্গী। এই সহজ আত্মীয়তার পথ করে দেয় প্রাচীন কাহিনি, যা সর্বশক্তিমান পরমারাধ্যকেও সহায়হীন মানুষের সমান করে তোলে। গোশালায় জিশুর জন্ম, কৃষ্ণের জন্ম কারাগারে, দু’জনেরই বিপরীতে রুষ্ট, বিদ্বিষ্ট শাসক— এমন বিপন্নতাই সেতুবন্ধন করে ঈশ্বরে আর মানুষে। সেই পথটুকু দিয়ে অকাতরে ভাগাভাগি হতে থাকে সুখ-দুঃখের জাগতিক উপকরণের। কে ভুলতে পারে আনাতোল ফ্রঁসের কাহিনির সেই বাজিগরকে, যে মাতা মেরির কাছে নিবেদন করেছিল নিজের একমাত্র গুণ— বল আর ছোরা লোফালুফির খেলা। সেই গল্পে মঠের অধ্যক্ষ হতবাক হয়ে দেখেছিলেন, মাতা মেরি বেদি থেকে নেমে নিজের বস্ত্রে সরলপ্রাণ ভক্তটির ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছেন। পুজোর বিধি, পূজকের যোগ্যতা, সব প্রশ্ন তুচ্ছ হয়ে যায় ভক্তপ্রাণের প্রেমে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy