—ফাইল চিত্র।
শেষ হয়েও যা শেষ হয় না, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে অন্তত তা একটি ট্র্যাজিক উপন্যাস। ২০০৮ সালে দেবীপক্ষের চতুর্থীর দিন টাটা মোটরস সিঙ্গুর থেকে বিদায়ের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। তার পরের পনেরো বছর প্রত্যক্ষ করেছে অনেক কিছুই— জমি অধিগ্রহণ অবৈধ ছিল বলে সুপ্রিম কোর্টের রায়, সেই জমিতে তৈরি হয়ে যাওয়া কারখানা গুঁড়িয়ে দেওয়া, জমি প্রত্যর্পণ, সেখানে সর্ষে চাষ। কাহিনি যে ফুরোয়নি, তিন সদস্যের সালিশি ট্রাইবুনালের রায়ে তা স্পষ্ট হল। ট্রাইবুনাল নির্দেশ দিয়েছে, টাটা মোটরস-কে ক্ষতিপূরণ দেবে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম, সুদে-আসলে অঙ্কটি ১৩৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি। অনুমান করা চলে, এই রায়ের বিরুদ্ধে ফের মামলা হবে, জল গড়াবে আরও, ট্র্যাজিক উপন্যাসটি দীর্ঘতর হবে। সেই উপন্যাসের ভাগ্যবিড়ম্বিত নায়কের নাম যে পশ্চিমবঙ্গ, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশমাত্র নেই। সিঙ্গুরে টাটা মোটরস-এর কারখানা চালু হলেই এই রাজ্যের সত্তা এবং ভবিষ্যৎ পাল্টে যেত কি না, সেই প্রশ্ন যদি মুলতুবিও থাকে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, সেই সম্ভাবনাটুকুও মুছে দিয়েছিল যুগপৎ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতা। আজ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা বাঁকা হাসি হেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত; অপর পক্ষে, নবান্ন প্রাণপণে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে যে, এই দায় একান্তই সিপিএমের। পশ্চিমবঙ্গের মূল ট্র্যাজেডি এখানেই— এ রাজ্যের রাজনীতি শুধু দলের স্বার্থ চিনেছে, রাজ্যের কথা ভাবার অবকাশ তার হয়নি।
খেয়াল করা ভাল, সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অবৈধ সাব্যস্ত হওয়ার পরে ট্রাইবুনালের বিচার্য ছিল— চুক্তি অনুসারে টাটা মোটরস-এর ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত কি না। কেন টাটা মোটরস এ রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, সে প্রশ্ন রাজনৈতিক ভাবে যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, এ ক্ষেত্রে তা প্রাসঙ্গিক নয়। শিল্পোন্নয়ন নিগম কোন দুঃসাহসে অবৈধ ভঙ্গিতে জমি অধিগ্রহণ করেছিল, বা দ্বিতীয় দেং জিয়াওপিং হতে উদ্গ্রীব বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই বা কোন অহঙ্কারে জমি ছিনিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন, আজ সেই প্রশ্নগুলি আবারও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পস্থাপন জরুরি ছিল, তা নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু, সিঙ্গুর-পর্বে কি রাজ্যের স্বার্থ অপেক্ষা মুখ্যমন্ত্রীর অহমিকাই প্রধান হয়নি? যে কাজে আইনানুসারী হওয়া প্রশাসনের কর্তব্য ছিল, এবং রাজনীতির দায়িত্ব ছিল সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি সংবেদনশীল হওয়া, ক্ষমতার দম্ভে সেখানে রাজ্যের সর্বনাশ ও নিজেদের রাজনৈতিক ভরাডুবি ডেকে এনেছিল তৎকালীন শাসক দল। অন্য দিকে, শিল্পমেধ যজ্ঞে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক লাভ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার মূল্য পশ্চিমবঙ্গকে চুকাতে হয়েছে। এখনও হচ্ছে। আশঙ্কা হয়, ভবিষ্যতেও হবে।
আরও দু’পক্ষই পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত— যদি তাতে দু’চার আনার রাজনৈতিক লাভ হয়! গত পনেরো বছরে অকিঞ্চিৎকর শক্তি থেকে প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠা বিজেপিও ঘোলা জলে মাছ ধরতে মশগুল। রাজ্যের দুর্ভাগ্য যে, কোনও পক্ষই দলের সঙ্গে সরকারের ফারাক বুঝতে শেখেনি। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পোন্নয়ন নিগমের সঙ্গে টাটা মোটরস-এর চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তির দায় এখনও নিগমের উপরেই বর্তায়। চুক্তির সময় কোন দল সরকারে ছিল, এখন কোন দল আছে, বা ভবিষ্যতে কোন দল থাকতে পারে, আইন বা প্রশাসনিকতার চোখে এই প্রশ্নগুলি অর্থহীন। সে কারণেই গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলগুলির কাছে দায়িত্বজ্ঞান দাবি করে— দল ক্ষমতায় থাকুক বা না-ই থাকুক, যে জনতার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য রাজনীতির পরিসরে দলের উপস্থিতি, তার স্বার্থরক্ষা করার কথাটি কোনও পরিস্থিতিতেই বিস্মৃত হওয়া চলে না। পশ্চিমবঙ্গের ট্র্যাজেডি, এ রাজ্যে কোনও দলই সেই দায়িত্বের কথা স্বীকার করতে রাজি নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy