দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পরাধীন ভারতে একাধিক বার রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের বলে কারারুদ্ধ হয়েছেন। কারাবরোধে বসেই তিনি বলেন, “মুক্তি আর দাসত্বের মধ্যে কোনও সমঝোতা হতে পারে না।... আমরা স্বাধীনতা অর্জন করব রক্তের মূল্যে, ক্লেশস্বীকারের মূল্যে।” সেই স্বাধীনতা অর্জনের পঁচাত্তর বৎসর পূর্ণ হতে চলেছে, তদুপলক্ষে ‘অমৃত মহোৎসব’-এর আয়োজন চলছে। এই উৎসবকে সত্যিই স্মরণীয় করে তুলতে হলে এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান কর্তব্য— দেশের নাগরিকের ‘দাসত্ব’ শর্ত ঘুচিয়ে তাকে ‘মুক্তি’র পরিবেশ দেওয়া। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি বাতিল করা হোক সেই লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ। এই আইন নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক বাক্বিস্তার হয়েছে, আদালতে অনেক মামলা চলেছে। আপাতত দরকার, মুখের কথা বা আইনের কচকচির উপরে উঠে, দেশের মৌলিকতম আদর্শটিকে ফিরিয়ে আনা জরুরি। এবং সেই কাজ যদি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে ঘটে, তা হবে আরও বেশি ‘ঐতিহাসিক’। কেননা, প্রধানমন্ত্রী নিজেও অবগত, দেশে-বিদেশে ইতিমধ্যে তাঁর সরকারের প্রধানতম ‘খ্যাতি’: অসহিষ্ণুতা। বিশ্বপৃথিবীর মঞ্চে ভারতকে অ-গণতন্ত্রের উদাহরণ করে তুলেছে তাঁর সরকারের গতিবিধি। বিবিধ রকম রাজনৈতিক, এমনকি সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবাদকে অঙ্কুরে বিনাশের লক্ষ্যে মোদী সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ আইন এবং ইউএপিএ-র মতো চরম বাক্স্বাধীনতা-নিষ্পেষণকারী আইনের যে এলোপাথাড়ি ব্যবহার করেছে, তা ভারতীয় নাগরিক সমাজের মেরুদণ্ড ভাঙার উপক্রম করেছে। আজ যদি ‘অমৃত মহোৎসব’ কার্যক্রমের কথা ভাবতেই হয়, তবে দেশকে গণতন্ত্রের অমৃত-পথে ফেরানোর কাজটিই হোক প্রথম।
সৌভাগ্যক্রমে সুপ্রিম কোর্টের কল্যাণে কেন্দ্রের কাছে এ কাজ করার একটি সুবর্ণসুযোগ এসেছে। সর্বোচ্চ আদালতে মামলা চলাকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কেন্দ্রীয় সরকার ‘যোগ্য’ ব্যক্তিদের হাতে সিডিশন আইনের পুনর্বিবেচনা করার প্রস্তাব আনলে আদালত তাতে সম্মতি দিয়েছে। অবশ্য গুরুতর একটি সংশয় থেকেই যায়। যে আইন সর্বতো পরিত্যাজ্য, তার পুনর্বিবেচনার দরকার কী? শীর্ষ আদালত যখন বাক্স্বাধীনতার অধিকারের সঙ্গে এই আইনের চূড়ান্ত মৌলিক বিরোধ নিয়ে আলোচনারত, নতুন করে বিবেচনা-র প্রশ্ন কেন? ঠিক, আগেও কয়েক বার এই আইন বিবেচনাসাপেক্ষে পুনর্বহাল হয়েছে, উল্লেখ্য ১৯৬২ সালে কেদারনাথ সিংহ বনাম বিহার রাজ্য মামলা। নেহরুও ব্যক্তিগত দ্বিমত সত্ত্বেও এই আইনকে রোধ করতে পারেননি।
সময় এক রকম থাকে না। ছয় দশকে যা হয়নি, গত আট বছরে তা ঘটেছে। প্রভূত সংখ্যায় এই আইনের যদৃচ্ছ অপব্যবহারে নাগরিকের নাভিশ্বাস উঠেছে। কোন কোন কারণে দেশদ্রোহের কঠোরতম অভিযোগে জামিনবিহীন গ্রেফতারি ঘটেছে, ফিরে দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। প্রেক্ষাগৃহে জাতীয়সঙ্গীত বাজানোর সময়ে উঠে না দাঁড়ানো দেশদ্রোহ। গোমাংস পাচারের সন্দেহে মানুষকে পিটিয়ে খুন করার প্রতিবাদে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখা, দেশদ্রোহ। সরকারের কোভিড নীতির সমালোচনা, দেশদ্রোহ। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং কৃষক আন্দোলন তো দেশদ্রোহ বটেই। এমনকি সমাজমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তা দেশদ্রোহ। নাগরিকের দোষ কী, সরকারি বিবেচনার সিঁদুরে মেঘে বিচলিত হলে? হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের লক্ষ্যে নিবেদিতপ্রাণ, কর্তৃত্ববাদী শাসনের দৃষ্টান্তপ্রতিম, বিরোধী ও সংখ্যালঘুর প্রতি নির্যাতনকারী সরকারের অভিভাবকত্বে এই দমনমূলক আইনের বিলোপের সম্ভাবনা ভাবা দুষ্কর। দুষ্কর হলেও অতীব জরুরি কাজটি শেষ অবধি হবে কি না— তা কিন্তু নির্ভর করছে সর্বোচ্চ আদালতের সতর্ক নজরের উপরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy