সদ্যসমাপ্ত দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ৪৮টি দখল করে আপ দলকে ধরাশায়ী করার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ‘যমুনা মা’র নামে জয়ধ্বনি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া। দিল্লি নির্বাচনের পূর্বে বিজেপির প্রচারের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল যমুনার ক্রমবর্ধমান দূষণ এবং তার সমাধানে আপ সরকারের ব্যর্থতার কথা। প্রত্যুত্তরে আপ-এর শীর্ষনেতারা আঙুল তুলেছিলেন পার্শ্ববর্তী হরিয়ানার দিকে। অভিযোগ গুরুতর— যমুনার জলে বিষ মেশানোর। এই মোক্ষম ভুলটিকে নির্বাচনী কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি বিজেপি শীর্ষনেতৃত্ব। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী স্বভাবোচিত ঢঙে জাঠ আবেগকে উস্কে জানিয়েছিলেন এই অভিযোগ হরিয়ানা এবং সমস্ত ভারতবাসীর কাছে অপমানস্বরূপ। সেই আবেগের জোর এমনই যে, পরবর্তী কালে হরিয়ানা থেকে বয়ে আসা নদীর জলে অ্যামোনিয়ার মাত্রা বৃদ্ধির কথা বলে আপ নেতারা পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলেও দিল্লির চল্লিশ শতাংশের অধিক হরিয়ানাবাসীর কাছে তা মান্যতা পায়নি। ‘হরিয়ানভি’ ভোটারদের বিপুল সংখ্যক ভোট গিয়েছে বিজেপির ঝুলিতে।
দিল্লির মধ্য দিয়ে পঞ্চাশ কিলোমিটারেরও অধিক জায়গা জুড়ে প্রবাহিত যমুনা দীর্ঘকালব্যাপী সরকারি অবহেলায় জীর্ণপ্রায় দূষণক্লিষ্ট। উৎসব লগ্নে বিষাক্ত ফেনায় ঢাকা যমুনার ছবি বহুলপরিচিত। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন, শিল্পনিঃসৃত বর্জ্য, অপরিশোধিত তরল অবাধে যমুনায় মেশার কারণে এমন ফেনার সৃষ্টি। বিপদ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেও। ২০২০ সালে তিনি স্বয়ং পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের আগে যমুনার স্বচ্ছ জলে ডুব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্য প্রতিশ্রুতিগুলির মতো এটিও গভীর দূষণে চাপা পড়ে থেকেছে। উপরন্তু তিনি দিল্লির বায়ুদূষণের মতোই যমুনাদূষণের যাবতীয় দায়ভারও হরিয়ানার উপর ঠেলে দিয়েছেন। কেজরীওয়াল সম্ভবত বিস্মৃত হয়েছিলেন, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য এমন দু’টি বিষয়, যাকে নিয়ে লোকদেখানোর রাজনীতি চলে না।
অবশ্য প্রশ্ন ওঠে, যাঁরা নির্বাচনে জিতে যমুনাকে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত করার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, দাবি করছেন যে কোনও সময় মানুষ নির্ভয়ে নদীতে ডুব দিতে পারবেন, দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হবে এই নদী, তাঁরা অন্য নদীগুলির ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিশ্রুতিটি পালন করেছেন কি? বহু কোটি ব্যয়ে দেশে চালু রয়েছে প্রধানমন্ত্রী স্বপ্নপ্রকল্প ‘নমামি গঙ্গে’। অথচ, দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বিলম্ব, দূষণ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অসম্পূর্ণতার ভারে বহু জায়গায় ধুঁকছে এই প্রকল্প। উন্নয়নের নামে বেলাগাম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পাহাড়ি নদীতে বিপদসঙ্কেত দিচ্ছে। মহাকুম্ভ মেলায় জলদূষণ ঠেকাতে বহুবিধ ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদেরই তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ জানুয়ারি প্রয়াগরাজ সঙ্গমের ‘বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড’ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি ছিল, যা জলের ব্যাপক দূষণেরই ইঙ্গিতবাহী। তাই এই প্রথম বার পরিবেশগত কারণ প্রত্যক্ষ ভাবে কোনও নির্বাচনী ফলকে প্রভাবিত করল, এই দাবি সত্য হলে আশা করা যায়, পরবর্তী কালেও মানুষ এমনই সুবিবেচনার পরিচয় দেবেন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)