ধান ভাঙার ঢেঁকি। —ফাইল চিত্র।
তবে কি দুয়োরানি ফিরে এল সুয়োরানি হয়ে? ঢেঁকিতে ছাঁটা চাল, কাঠের ঘানিতে পেষা তেল, গোবর সারে ফলানো আনাজ আজ দোকানের তাকে, মেলার স্টলে, সমাজমাধ্যমের পোস্টে ঘোষণা করছে, ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’। সেই কবে এগুলোকে ‘সেকেলে’ ছাপ মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বাজারের বাইরে। গুটিকয় চাষির ঘরে কোনও মতে টিকে ছিল। এখন আবার প্রাসাদোপম সুপারমার্কেটের সাতমহলায় তাদের বরণ করে তোলা হচ্ছে। ‘অর্গানিক’ বা জৈব শব্দটি শস্য, আনাজ, মুরগির ডিম থেকে সুতির কাপড়, সব কিছুর সম্মুখেই রাজদত্ত উপাধির মতো বিরাজ করছে। দামের লেবেল দেখেই মালুম হয়, উপাধির গুমোর কত। জিভ-মাতানো স্বাদ, নাক-মাতানো গন্ধের আশায় ভোজনরসিক বাঙালি দ্বিগুণ দাম দিয়ে কিনে আনছে গোবর-জাত গোবিন্দভোগ, বাড়িতে-ভাঙানো মুগ ডাল, হাতে-গুঁড়োন ধনে-জিরে। একটা মরিয়া আশাও রয়েছে— রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র থেকে দেহের ভিতরের যন্ত্রপাতিগুলো যদি আর কিছু দিন টেকে। কাণ্ড দেখে সেকেলেরা হয়তো মুচকি মুচকি হাসছেন, আর গুনগুন করছেন রবীন্দ্রনাথের গানের কলি, “পাওয়া ধন আনমনে হারাই যে অযতনে/ হারাধন পেলে সে যে হৃদয়-ভরা।” চক্রাকারে কেবল কি সুখ-দুঃখই আবর্তিত হয়? ঘোরে রুচি, পছন্দ, আশা-আকাঙ্ক্ষাও। না হারালে যেন বোঝা যায় না, কী ছিল, কী খোয়া গিয়েছে। তাই আজ চিঠির বাক্সে বিজ্ঞাপন, সমাজমাধ্যমে পোস্ট, মোবাইলে ঘন ঘন বার্তা— কালো চাল, খয়েরি চাল, লাল চাল, আর্সেনিক-মুক্ত জলে সেচ-দেওয়া চাল, দিশি বীজে চাষ-করা চাল, ফোনের ওপারে সবই মজুত।
‘হাওয়া বদল’ কিসে না হয়— পোশাকে, সাজ-গোজে, পুজোমণ্ডপের সজ্জায়, ভ্রমণের গন্তব্যে। তবে সবই কি আর হঠাৎ-হাওয়ায় ভেসে আসা রুচির বদল? দিশি চাল, জৈব চাষ, ঢেঁকি-ঘানির প্রযুক্তিতে ফিরে যাওয়া মানে, বদলে যাচ্ছে ভরসার ভরকেন্দ্র। সবুজ বিপ্লবের যুগে চাষি, গয়লা, তেলি থেকে আস্থা সরে গিয়েছিল বিজ্ঞানীর গবেষণাগার, আর বিশ্বজোড়া বাজারে। চার দশক পার হতে না-হতে পরিবেশ বিজ্ঞানী আর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, দু’জনেই ভয়ঙ্কর ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করছেন, এক গরাস ভাত, কি এক চামচ চিনিতে কী আছে, তার খোঁজ কি আছে? শরীরের ভিতরে নীরব বিষক্রিয়া চলছে, আর বাইরে শূন্য হচ্ছে ভূগর্ভের জল, অনুর্বর হচ্ছে মাটি। তার উপর প্রতারণার কটু স্বাদ— বিদেশের পরীক্ষায় যে সব শস্য-আনাজ-চিংড়ি ফেল, দেশের বাজারে তারা দিব্যি পাশ। এ কেমন কথা? বিলেত-আমেরিকার তাগড়া লোকের যা সয় না, তা বুঝি পেটরোগা বাঙালির সয়? ক্রেতাকে ভরসা দিতে জৈব খাদ্যের কারবারিরা ছেপে দিচ্ছেন, কোন খেতের চাল,
কোন ভেড়ির মাছ বিকোচ্ছেন তাঁরা। দিল্লি-সহ কিছু শহরে চালু হয়েছে নতুন প্রথা, ক্রেতা সম্বৎসরের জন্য জমির ঠিকা নিতে পারবে সংস্থার থেকে, সংস্থার নিযুক্ত চাষি তার পছন্দসই শস্য-আনাজ ফলিয়ে দেবে। যুধিষ্ঠিরের সুখের সংজ্ঞাকে সামান্য সংশোধন করে আজ বলা চলে, নিজের খেতে তৈরি চালের ভাত, নিজের বাগানে গজানো শাক খেয়ে শুতে যায় যে, সে-ই সুখী।
তা হলে কি সাবেকপনাতেই সুখ? আবেগ বস্তুটি সততই পশ্চাৎমুখী, আর ধনধান্যশালী সোনালি অতীতের কল্পনা বাঙালির মজ্জাগত। তাই চোখে পড়ে না মূল অসুখ— আস্থার সঙ্কট। সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকে আস্থার উপর, যা সব সহযোগিতার ভিত্তি। বিশেষজ্ঞরা আস্থাকে ‘সামাজিক পুঁজি’ বলেন। টাকাপয়সা যেমন অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মূলধন, তেমনই পরস্পর ভরসার সম্পদটুকু হাতে না থাকলে সমাজ অচল। বৃহৎ ব্যবস্থার জন্য দরকার হয় আস্থার বিস্তৃত পরিসর। সংগঠিত ধর্ম, রাজনৈতিক আন্দোলন, গণতান্ত্রিক প্রশাসন, এই সব কিছুরই ভিত্তি আস্থা। ব্যবস্থাই আবার আস্থার অভ্যাস তৈরি করে— বিদেশি সংস্থার অচেনা কর্মীর ভরসায় প্রাণদায়ী ওষুধ খাই আমরা। চেনা দোকান ‘বাড়িতে তৈরি’ ঘি বিক্রি আস্থার পরিসরকে সঙ্কুচিত করে মাত্র। গোয়ালার গাঁয়ের বাড়ি ততটাই অদেখা, যতটা গুজরাতের
ডেয়ারি, কিংবা নেদারল্যান্ডসের মাখন কারখানা। চাষির থেকে সরাসরি ফসল কেনার পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। উৎপাদক-ক্রেতার মধ্যে মানবিক সম্পর্কের মূল্যটি কম নয়। কিন্তু বৃহৎ বাজার কেন আস্থার যোগ্য থাকছে না, খাওয়ার পাতে সেই তেতো প্রশ্নটিও রাখা চাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy