শব্দ-যন্ত্রণা যে কত মর্মান্তিক, তা ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন। যেমন জেনেছেন কলকাতার বাসিন্দা শগুফতা সুলেমান। অষ্টপ্রহর শব্দ-যন্ত্রণার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকেছেন তিনি। অভিযোগ, তাঁর নিকটবর্তী এক বেআইনি নির্মাণস্থলে দিবারাত্রি কাজ হচ্ছে, লাউডস্পিকার বাজছে। প্রতিবাদ করতে গেলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি অভিযোগটি শুনেছেন, এই বিষয়ে প্রশাসনের ভূমিকা দেখেছেন এবং শগুফতাকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দানের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশকে। মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ। শব্দদূষণ এই শহরে এবং রাজ্যের অন্যত্রও সাধারণ নাগরিককে কী ভাবে প্রতিনিয়ত অতিষ্ঠ করে, তার প্রমাণ এতে মেলে। অথচ, শব্দদূষণকে ‘দূষণ’-এর গোত্রে ফেলা এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবহিত হওয়া— এই দুই কাজেই এযাবৎ কাল চূড়ান্ত ঢিলেমি প্রদর্শিত হয়েছে। নাগরিক, প্রশাসন— উভয় তরফেই।
বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় গত শতকের নব্বইয়ের দশকে রায় দিয়েছিলেন— ‘না-শোনা’ও প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার। শব্দতাণ্ডবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এই রায়টি ক্রমে এক অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত হয়। পরবর্তী কালে তাঁর রায়ের উপর ভিত্তি করেই শব্দের ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত নিয়মগুলি কার্যকর করা হয় রাজ্য ও কেন্দ্রে। অথচ, আড়াই দশক পরে এই শহরেই শব্দযন্ত্রণার শিকার হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে হল এক তরুণীকে। সত্য হল, বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রায়ে কলকাতা শহরের যে প্রত্যাশিত রূপের কল্পনা ছিল, মহানগর সেই অভীষ্টে পৌঁছায়নি। সম্প্রতি কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের এক হলফনামায় প্রকাশ, অবাঞ্ছিত হর্ন বাজানোয় গত আড়াই বছরে আড়াই লক্ষেরও বেশি মামলা দায়ের হয়েছে পুলিশে। এবং তার মধ্যে অধিকাংশই ‘নো হর্ন জ়োন’-এর নিরিখে। কালীপুজো, বর্ষবরণ, বিবাহ— যে কোনও উৎসবে শব্দতাণ্ডবই এই শহরের বৈশিষ্ট্য। জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশানুসারে শব্দযন্ত্রে ‘সাউন্ড লিমিটর’ বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছিল। সেই নির্দেশ কত দূর কার্যকর হয়েছে? সদ্য তার একটি প্রমাণ পাওয়া গেল— কোলাহলপূর্ণ শহরের তালিকায় দুনিয়ার চতুর্দশতম স্থানে রয়েছে বাংলার দুই শহর, কলকাতা ও আসানসোল।
শগুফতার ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল, কারণ যে নির্মাণকাজের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, সেটি বেআইনি। এই ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত কোনও নিয়মই যে মানা হবে না, তা প্রত্যাশিতই। ঘটনাটি ব্যতিক্রম নয়। পুর-প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যত্র তত্র যে সমস্ত বেআইনি কারখানা, নির্মাণ চলছে, তাদের প্রত্যেকটি সর্ব প্রকার দূষণ নিয়মিত সৃষ্টি করে চলেছে। শব্দদূষণ-সহ অন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবিলম্বে এই বেআইনি কাজকর্ম বন্ধ করতে হবে। যে কোনও প্রকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। সেই আইন যাতে রাজনৈতিক রং না দেখেই প্রয়োগ করা যায়, সেই ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। সর্বোপরি, নাগরিককেও সচেতন হতে হবে। অকারণে হর্ন বাজানো যে সভ্যতার পরিচায়ক নয়, তা মানতে হবে। বুঝতে হবে, উৎসব মানেই ডিজে, লাউডস্পিকার, শব্দবাজির তাণ্ডব নয়। প্রশাসন, নাগরিক— উভয়ের বোধোদয় না হলে শব্দদূষণ কমবে না। পরিত্রাণের জন্য তখন আদালতই ভরসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy