প্রতীকী ছবি।
টিকাকরণের প্রচার পুরাদমে চলিতেছে। সংবাদ আসিল, তিন হাজার নির্মাণকর্মীকে টিকা দিবেন দিল্লি মেট্রো কর্তৃপক্ষ, উৎসাহদানের জন্য আয়োজিত হইবে পথ-নাটিকা। তাহা অভিনীত হইবে উত্তর ভারতের বিবিধ গ্রামীণ উপভাষায়, শুনাইবে জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত— উক্ত কর্মীদের পরিচিত মাধ্যমে। গণটিকাকরণে স্থানীয় ভাষা ও জনপ্রিয় সংস্কৃতির গুরুত্বের কথা উল্লেখ করিয়াছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রক। যদি সকলের নিকট টিকা পৌঁছাইতে হয়, যদি সমাজ-অর্থনীতিতে প্রান্তিক মানুষকে সুরক্ষা দিতে হয়, যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করিতে হয়, তাহা হইলে তাঁহাদের ভাষাতেই কথা বলিতে হইবে। তৎসূত্রেই বিদর্ভের প্রত্যন্ত গ্রামে সচেতনতার প্রচার হইয়াছে কোরকু ভাষায়, দক্ষিণ রাজস্থানের কিছু অঞ্চলে ওয়াগদি উপভাষায়, ছত্তীসগঢ়ের জনজাতিপ্রধান অধ্যুষিত অঞ্চলে তাঁহাদের গানে। বিগত বৎসরেও, বহু এলাকায় প্রাঞ্জল স্থানীয় ভাষায় লিখিত প্রচারপত্রেই ছড়াইয়া পড়িয়াছিল অতিমারি বিষয়ক সতর্কতা।
দিনের পর দিন তারকা-কণ্ঠে সতর্কতার প্রচার যতটুকু ফলদান করে, স্থানীয় ভাষায় প্রচারের অভিঘাত তাহার তুলনায় কম নহে। যাহা ঘরের ভাষা, যে ভাষায় মানুষ পরিজনদের সহিত নিরন্তর বাক্যালাপ করিয়া থাকে, তাহার উপর শুধু সহজাত দখল থাকে না, ভালবাসাও থাকে। বাহিরের ভাষা— শিক্ষার ভাষা হউক বা সরকারি ভাষা— প্রয়োজনীয় হইলেও মনের তাদৃশ নিকট পৌঁছাইতে পারে না। স্মরণীয়— মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সহিত তুলনা করিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁহার মত, মাতৃভাষায় কোনও ‘ভেজাল’ নাই, তাহাতে বস্তুর সহিত প্রাণ বিদ্যমান, অতএব স্বাভাবিক ছন্দে চিন্তার বিকাশ ঘটাইবার সহায়ক। ১৯৫১ সালে শিক্ষায় ‘ভার্নাকুলার’ ভাষার প্রয়োগ সংক্রান্ত রিপোর্টে ইউনেস্কো বলিয়াছিল, ঘরের ভাষা যদি স্কুলশিক্ষারও ভাষা হয়, তবে ঘর আর শিক্ষার ভিতর বিরোধ সৃষ্টি হয় না। কঠিন কথার মাধ্যমও কঠিন হইলে তাহা জনতা অবধি পৌঁছাইতে পারে না, তাহাতে মানসিক প্রতিরোধ তৈরি হয়, উহাকে সহজপাচ্য করিয়া জ্ঞাপন করাই কার্যকর উপায়।
সঙ্কটকালে যে সেই ‘আপন’ ভাষার ব্যবহার হইতেছে, তাহা মঙ্গলজনক। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তাহা কেবল আপন বুলির প্রতি টান নহে, নিজের দেশের অভিজ্ঞান— বহুভাষিকতার অভিজ্ঞান। এ দিকে অধুনা দেশাত্মার স্মারক নির্মাণের বহু উদ্যোগ লক্ষণীয়, এক ভাষায় ভারতকে চিনাইতে যৎপরোনাস্তি সচেষ্ট কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি। তাহাদের বক্তব্যের নির্যাস, যে ভাষায় ‘অধিকাংশ’ মানুষ কথা বলেন, সেই ভাষাই ভারতকে ‘বাঁধিয়া’ রাখিতে পারে, তাহাতেই ভারতের পরিচিতি। অধিকাংশ মানুষ হিন্দি— সরকারি মান্য হিন্দি— বলেন কি না, তাহা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু বাঁধিয়া রাখে সম্ভবত তাহাই, যাহা মানুষের সহিত যোগস্থাপন করে, মানুষও যাহার সহিত একাত্ম বোধ করেন। অতিমারিতে আরও এক বার প্রমাণিত যে, কোনও এক ভাষা, এমনকি প্রাদেশিক সরকারি ভাষাও বৃহত্তর জনতার সহিত আদানপ্রদানে স্বচ্ছন্দ নহে, ক্ষেত্রবিশেষে সমর্থও নহে। বরং বহু ক্ষুদ্র ভাষা, যাহার অধুনা বিপন্নও বটে, তাহারাই বহু নাগরিক অবধি পৌঁছাইয়া কাজের সহায়ক হইতেছে। এই বহুত্বই কিন্তু ভারতের প্রকৃত পরিচিতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy