গোড়ার কথাটি গোড়াতেই বলা জরুরি। সোমবার সন্ধ্যায় প্রতিবাদী চিকিৎসকরা এক দীর্ঘ ও গভীর উদ্বেগের অবসান ঘটিয়েছেন। অগণিত শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক অনেক দিন পরে নিশ্চিন্ত হওয়ার অবকাশ পেয়েছেন। এই সামূহিক উদ্বেগ সৃষ্টির কোনও সুযুক্তি ছিল না। আমরণ অনশন কখনওই কোনও আন্দোলনের সঠিক বা যথার্থ পথ হতে পারে না, সেই আন্দোলন যত ন্যায়সঙ্গত এবং গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন। সতেরো দিন এই ভুল পথে চলার পরে শেষ অবধি জুনিয়র চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে, উদ্বিগ্ন নাগরিকদের পরামর্শে এবং আর জি কর হাসপাতালে অত্যাচারিত ও নিহত চিকিৎসকের মা-বাবার অনুরোধে তাঁরা অনশন শেষ করলেন। এই যুক্তি শুনে এই সংশয় স্বাভাবিক যে, আসলে তাঁরা একটি কানাগলি থেকে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজছিলেন। পাশাপাশি, স্বাস্থ্য ধর্মঘট নামক আরও একটি কানাগলিতে প্রবেশের যে উপক্রম করেছিলেন, তাতে নিরস্ত হয়েও তাঁরা সুবিবেচনার কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রেও তাঁদের যুক্তিটি বিস্ময়কর, স্বাস্থ্য ধর্মঘট করে রোগীদের বিপদে ফেলে ‘হৃদয়হীন’ সরকারের মনে আঁচড় কাটা যাবে না, এই কথাটি নাকি তাঁরা সোমবারের আলোচনার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছেন! তবু, যে কারণেই হোক, কানাগলি পরিহার করা সব সময়েই স্বস্তিদায়ক।
এ বার প্রশ্ন: অতঃপর? সরকারি হাসপাতাল তথা স্বাস্থ্যব্যবস্থার যথার্থ সংস্কারের যে দাবিগুলি এই আন্দোলন থেকে উঠে এসেছে, সেগুলির গুরুত্ব নিয়ে তো কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। এবং রাজ্যের শাসকরা মুখে যতই বলুন যে তাঁরাও এই সব দাবিকে সমর্থন করেন, তাঁদের সেই কথায় ভরসা রাখা অত্যন্ত কঠিন। লক্ষণীয়, গত কয়েক দিন ধরে শাসক দলের নানা মাপের রকমারি নেতা মন্ত্রী বিধায়ক, এমনকি দলীয় মুখপাত্ররা উৎকট ভাষায় বা ভঙ্গিতে আন্দোলনকারী চিকিৎসক ও নাগরিকদের আক্রমণ করে চলেছেন, এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁদের তিরস্কার করে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। এই আচরণ কি এক বিপুল অহমিকা এবং অসহিষ্ণুতার প্রকাশ নয়? সোমবারের সভাতেও এই ব্যাধির লক্ষণ প্রকট ছিল। ‘অভিযুক্ত’ শব্দটির অর্থ মুখ্যমন্ত্রী বোঝেন না— এই ‘ব্যাকরণ মানি না’ স্বভাব নিতান্ত সুপরিচিত এবং, এক অর্থে, নিতান্ত গৌণ। কিন্তু একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষকে অন্যায় ভাবে তিরস্কার করে, এবং বস্তুত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের স্বশাসনের প্রাথমিক অধিকারকেই নস্যাৎ করে রাজ্যের কর্ণধার জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর গণতান্ত্রিকতার বোধ কতটাই অগভীর এবং ঠুনকো। স্বাস্থ্যব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অসংখ্য অভিযোগ উদ্ঘাটিত হয়ে চলেছে, তা দূর করার জন্য এমন শাসকের ‘শুভবুদ্ধি’র উপর আস্থা রাখতে পারা অসম্ভব।
এবং সেখানেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গুরুত্ব। অনশন বা ধর্মঘটের ভ্রান্ত পথে নয়, যথার্থ অনাচারগুলিকে সামনে এনে, নাগরিকদের সেই বিষয়ে অবহিত ও সচেতন করার আন্দোলন জোরদার করা অতীব জরুরি। বহু বিলম্বের পর, বহু দাম দিয়ে শুরু হয়েছে এই সচেতনতা। চিকিৎসকদের এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে, দায়িত্বশীল ভূমিকা। আশা করা যায়, আড়াই মাসের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিতে পেরেছেন। দায়িত্বজ্ঞানহীন হঠকারিতা, সস্তা প্রচারের আকর্ষণ, যথার্থ বিকল্প নির্মাণের পরিশ্রম না করে নিছক সংঘর্ষের উন্মাদনা— এই সমস্ত বিপদের অনেক লক্ষণই সাম্প্রতিক আন্দোলনের পরিসরে প্রকট হয়েছে। নাগরিকদেরও দায়িত্ব, এই ধরনের বিপজ্জনক বিভ্রান্তি থেকে প্রতিবাদী আন্দোলনকে দূরে রাখা। সোমবারের বৈঠক আবার দেখিয়ে দিয়েছে, রাজ্যের শাসকরা জানেন কী ভাবে কার্যসিদ্ধি করতে হয়। এই বাস্তবকে স্বীকার করেই দরকার দুর্নীতি, দুরাচার এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। রাজনৈতিক বুদ্ধি ছাড়া প্রতিস্পর্ধা সার্থক হতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy