বাজার চলে কোন জ্বালানির জোরে, সেই প্রশ্নের একমেবাদ্বিতীয়ম্ উত্তর হল, চাহিদা। মানুষ যত কিনবেন, ততই উৎপাদন বাড়বে, ততই উজ্জীবিত হবে বাজার। সেই চাহিদা আসবে কোথা থেকে? মানুষের প্রয়োজনই কি চাহিদার উৎস, না কি আকাঙ্ক্ষা— অথবা, মহাত্মা গান্ধী যাকে বলেছিলেন লোভ? বাজার জানে, শুধু প্রয়োজন মেটানোর চাহিদায় অর্থব্যবস্থার বাণিজ্যিক ক্ষুধা মেটার নয়। তার আরও চাহিদা প্রয়োজন— আকাঙ্ক্ষার গর্ভে যে চাহিদার জন্ম। তাতে আপত্তি করার কোনও কারণ থাকত না, যদি না পরিবেশকে সেই চাহিদার ধকল সইতে হত। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর যত জামাকাপড়, যত জুতো, যত মোবাইল ফোন-কম্পিউটার, যত খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হয়ে চলেছে, তার পরিমাণ প্রকৃত অর্থেই অকল্পনীয়। প্রতি মিনিটে উৎপন্ন হচ্ছে ১,৯০,০০০টি জামা; প্রতি দিন তৈরি হচ্ছে পঁচিশ লক্ষ জুতো, প্রায় সত্তর হাজার ফোন। বছরে তৈরি হচ্ছে প্রায় পঞ্চাশ কোটি টন প্লাস্টিক। বিপণনের হাতছানি ক্রেতাকে প্রতি দিন নতুন পণ্যের দিকে ডাকছে, ফলে সামান্য ব্যবহারেই বাতিল হয়ে যাচ্ছে কিছু দিন আগে কেনা জামাকাপড়, ফোন, এমনকি গাড়িও। কিন্তু, বাতিল হচ্ছে বলেই তো তা উবে যাচ্ছে না পৃথিবী থেকে— সেই বর্জ্য বিভিন্ন হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত এসে পড়ছে প্রকৃতির বুকে। উন্নত দেশগুলি জাহাজ-বোঝাই বর্জ্য পাঠাচ্ছে আফ্রিকায়; দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন শহরে জমে উঠছে ই-বর্জ্যের পাহাড়। জলে মিশছে প্লাস্টিক, ফসলে ঢুকছে ক্ষতিকর রাসায়নিক, বাতাসে মিশছে বিষ। সেই বিষ আবার ফিরে আসছে মানুষের কাছেই— তার জলে, তার খাদ্যে, তার শ্বাসবায়ুতে। এবং, সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে গরিব মানুষের জীবনে— ভোগবাদের প্রতিযোগিতায় যাঁরা যোগ দিতে পারেন না, তাঁরা পান করতে বাধ্য হচ্ছেন সেই সমুদ্রমন্থনে উঠে আসা গরলের সিংহভাগ।
এর থেকে বাঁচার একটি পথের সন্ধানও পেয়েছেন সচেতন মানুষরা। স্বাভাবিক পথ— চাহিদাকে লাগামছাড়া হতে না দেওয়া। একই জামা বেশি দিন ধরে পরা, একই জিনিস ব্যবহার করা আরও কিছু দিন। দোকানে গিয়ে ‘নতুন’-এর খোঁজে আত্মহারা না হওয়া। এমন কিছু পোশাক বিপণি উঠে এসেছে, যারা ফ্যাশনের সিজ়ন বা ঋতু উত্তীর্ণ হলেই সেই পোশাককে বাতিল করে দেয় না, বরং অন্য ভাবে বিক্রির চেষ্টা করে। এর নাম ‘স্লো ফ্যাশন’। তবে, কয়েক জন সচেতন ব্যবসায়ী এই প্রক্রিয়ার সূচনা করতে পারেন মাত্র, তাঁদের পক্ষে গোটা ছবিটি বদলে দেওয়া অসম্ভব। বরং, পরিবেশকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে অন্যরা লাভের মাত্রা বাড়িয়েই চললে এই সচেতন ব্যবসায়ীদের সামনে দু’টি পথই খোলা থাকবে— হয় সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া, নয় লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাজার ছাড়া। প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য যেমন সামগ্রিক সচেতনতা চাই, তেমনই চাই সরকারি স্তরে উদ্যোগ। ভোগব্যয় বাড়লে সব দেশের সরকারেরই লাভ, কিন্তু পরিবেশের ক্ষতিও ক্রমে ঘোরতর অর্থনৈতিক বিপদের রূপ পরিগ্রহ করছে। অতএব, ব্যবসার স্বার্থ যাতে পরিবেশের স্বার্থকে বিঘ্নিত করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এক দিকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সবুজ দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে হবে, অন্য দিকে মানুষের মধ্যেও সচেতনতার প্রসার করতে হবে। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক ন্যায়ের কথাও— উন্নত বিশ্বের বোঝা যাতে দরিদ্র দেশগুলিকে বইতে না হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)