ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গ থাকিল পশ্চিমবঙ্গেই। আরও একটি নির্বাচন হইল, আরও এক বার স্পষ্ট হইয়া গেল যে, গণতন্ত্র অনুশীলনের মানসিকতা এই রাজ্যের বৈশিষ্ট্য নহে। বিধাননগর পুরভোটের পর শাসক দলের এক উচ্চস্তরের নেতা আত্মপ্রসাদের হাসি হাসিয়া যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার মর্মার্থ ছিল এই রূপ: ত্রিপুরায় নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে যদি বিজেপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে, বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসই বা জিতিবে না কেন? অর্থাৎ, জোর যাহার, মুলুক অর্থাৎ পঞ্চায়েত বা পুরসভাও সর্বাংশে তাহারই। এই বার এখনও এমন কোনও কথা বলিবার প্রয়োজন হয় নাই। শাসকপক্ষ সম্ভবত নিশ্চিত হইয়াছে, গণতন্ত্রের এই অবমাননায় অভ্যস্ত হইতে হইতে রাজ্যবাসী তাহাকে স্বাভাবিক বলিয়াই ধরিয়া লইয়াছে। ঘটনা হইল, বিধানসভায় আসনসংখ্যার জোর, বা পাড়ার মোড়ে বাহুবলীদের জোরের উপর এমন বিশ্বাস বর্তমান জমানার ফসল নহে— হাওয়ায় কান পাতিলে এখনও ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০’-এর প্রতিধ্বনি শুনা যাইবে। সেই আমলেও বিরোধীপক্ষের ভোটাররা ভয়ে থাকিতেন, আজও থাকেন। আর পাঁচটি ক্ষেত্রের ন্যায় সংখ্যার জোরে গণতন্ত্রকে অপমান করিবার কু-অভ্যাসটিও পুরাতন জমানার উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছে বর্তমান শাসকপক্ষ; এবং ব্যতিক্রমহীন ভাবে তাহাকে কুৎসিততর, ভয়ঙ্করতর করিয়া তুলিয়াছে। ফলে, যে নির্বাচনে জয় কার্যত নিশ্চিত, সেখানেও কব্জির জোরে ভোট করাইবার প্রবণতা প্রকট। সাংবাদিক নিগ্রহও চলিতেছে। গণতন্ত্রহীনতার এই অভ্যাসের কোন দাম পশ্চিমবঙ্গকে চুকাইতে হইবে, তাহা ভাবিলেও আতঙ্কিত হইতে হয়।
বিরোধী কাহারা, শাসক দলের নিকট এই প্রশ্নেরও প্রকৃষ্ট উত্তর আছে কি? শুধু অন্য দল নহে, নিজের দলের মধ্যেও যে ‘বিরোধী’র সন্ধান মিলিতেছে, বিভিন্ন সংবাদে তাহা স্পষ্ট। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কোনও নূতন সংবাদ নহে, কিন্তু তাহার প্রকাশ ক্রমশ ভয়াবহতর হইতেছে। মুষলপর্বের সূচনা যে এই ভাবেই হয়, শাসকপক্ষ তাহা স্মরণে রাখিতেছে নিশ্চয়ই। অন্য দলের ক্ষেত্রেই হউক, বা স্বদলের ভিন্ন গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, প্রবণতাটি এক— যেখানে গায়ের জোর আছে, সেখানে কোনও বিরুদ্ধ মতকে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়া নহে। জমি ছাড়িবার মালিক যে শাসক দলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নহে, গণতন্ত্রে এই অধিকার যে শুধুমাত্র নাগরিকের উপরই ন্যস্ত, সংখ্যা এবং জোরের ঔদ্ধত্যে এই কথাটি ভুলিয়া যাওয়াই বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির বৃহত্তম বিপদ।
শাসক দল রাজনীতির খেলার এই নিয়মটি বাঁধিয়া দিয়াছে। এবং এই রাজ্যের দুর্ভাগ্য, বিরোধীপক্ষও সেই নিয়ম মানিয়াই খেলিতে আগ্রহী। রাজনৈতিক কল্পনাশক্তির বিন্দুমাত্র পরিচয় তাহারা দেয় নাই। রাজ্যের যে প্রান্তে তাহারা কব্জির জোর অর্জন করিতে পারিয়াছে, সেখানে শাসক দলকে পাল্টা মার দেওয়াই যে রাজনীতির পরাকাষ্ঠা নহে, এই সহজ কথাটি তাহারা বুঝে নাই। রাস্তার রাজনীতি অতি উত্তম বস্তু, কিন্তু সম্পূর্ণ রাজনীতিটিকেই রাস্তায় নামাইয়া দিলে তাহার মাহাত্ম্য খণ্ডিত হয়। সংসদীয় পরিসরে রাজ্যের গণতন্ত্রহীনতা লইয়া প্রতিবাদ, বিতর্ক, অথবা নাগরিক পরিসরে জনসংযোগ— বিরোধী দলগুলির যে দায়িত্ব, তাহার কোনওটিই তাহারা পালন করিয়াছে কি? বাম দলগুলি অতিমারির আবহে সমাজসেবা-কেন্দ্রিক জনসংযোগ করিয়াছে, কিন্তু, সেই পর্যন্তই। সমাজসেবা আর রাজনীতির মধ্যে যোগ যতটা, দূরত্বও ততোধিক। সেই গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিসরে বামপন্থীরাও বিজেপির মতোই সম্পূর্ণত অনাগ্রহী এবং অদক্ষ। মাঝখান হইতে, শাসক দলের ক্ষমতাদর্পের আস্ফালন এবং বিরোধী দলের নির্বিকল্প পেশিক্ষমতা সাধনা— উভয় মিলিয়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি দ্রুত এক বর্বর ভূমিতে পরিণত, যাহা হইতে নিষ্ক্রমণের পথ পাওয়া ক্রমশ অসম্ভব ঠেকিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy