Advertisement
২৪ অক্টোবর ২০২৪
Eklavya Model Residential Schools

স্বভূমে ভাষাহীন

উত্তর ভারতের কোনও শিক্ষক যখন চাকরি নিয়ে ঝাড়খণ্ড বা ছত্তীসগঢ়ের কোনও একলব্য স্কুলে পড়াতে আসবেন, স্থানীয় ও জনজাতি গোষ্ঠীর ভাষা না জানলে পড়াশোনা বোঝা পরের কথা, অল্পবয়সি ছাত্রছাত্রীরা তাঁর মুখের কথাই বা বুঝবে কী করে?

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৪ ০৯:১০
Share: Save:

উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া মডেল অন্তত শিক্ষার ক্ষেত্রে, স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে সর্বদা কাজে দেয় না, শিক্ষার্থীদের আসল প্রয়োজন বুঝে ভিতর থেকে ব্যবস্থাটাকে গড়েপিটে নেওয়াটাই আসল কাজ। সরকার এ কথা বুঝবে, এমন আশা নেই। তার করুণ পরিণতি দেখা যাচ্ছে জনজাতি গোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীদের স্কুলগুলির ক্ষেত্রে। দেশ জুড়ে চারশোরও বেশি ‘একলব্য মডেল রেসিডেনশিয়াল স্কুল’ রয়েছে, বিজেপি সরকার কিছু কাল হল এই স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সরাসরি কেন্দ্রের অধীনে নিয়ে এসেছে, ‘ন্যাশনাল এডুকেশন সোসাইটি ফর ট্রাইবাল স্টুডেন্টস’ (এনইএসটিএস) তৈরি করে। সব সময় সব কিছু দিল্লিমুখী হলে যা হওয়ার, এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে— জনজাতি গোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীদের পড়াবেন যাঁরা, সেই হবু শিক্ষকদের ভাষাজ্ঞান যাচাইয়ের লিখিত পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে শুধু হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার প্রশ্ন। জনজাতি গোষ্ঠীর ভাষা তো দূরস্থান, স্থানীয় ভাষারও নয়।

অথচ এটাই কি প্রধান শর্ত হওয়া দরকার ছিল না? উত্তর ভারতের কোনও শিক্ষক যখন চাকরি নিয়ে ঝাড়খণ্ড বা ছত্তীসগঢ়ের কোনও একলব্য স্কুলে পড়াতে আসবেন, স্থানীয় ও জনজাতি গোষ্ঠীর ভাষা না জানলে পড়াশোনা বোঝা পরের কথা, অল্পবয়সি ছাত্রছাত্রীরা তাঁর মুখের কথাই বা বুঝবে কী করে? এ কথা বুঝতে মন্ত্রী, সরকারি আমলা বা শিক্ষাবিদ হতে হয় না যে, যে রাজ্যের যেটি স্থানীয় ভাষা, ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনেই শিক্ষকদের তাতে পূর্ণ দক্ষতা প্রয়োজন, আর জনজাতি গোষ্ঠীর স্কুলগুলির ক্ষেত্রে তা নিঃশর্ত ভাবে আবশ্যক। এনইএসটিএস-এর সূত্রে গত বছর একলব্য স্কুলগুলিতে নিয়োগ হওয়া শিক্ষকদের থেকে এরই মধ্যে প্রচুর বদলির আবেদন এসেছে বলে খবর, কিন্তু এটাই কি হওয়ার ছিল না? তেলঙ্গানায় দেখা গিয়েছে ৪৭ জন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের মধ্যে ৪৪ জন হরিয়ানার, এক জনও সে রাজ্যের নন। এই শিক্ষকেরা হিন্দি ভাষায় দক্ষ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি করতে এসেছেন, কিন্তু তেলুগু ও জনজাতি গোষ্ঠীর ভাষার জ্ঞান ছাড়া কি তাঁদের পড়ানোর কাজটি হবে? দেহরাদূন থেকে এসে কেউ কি পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত একলব্য স্কুলে পড়াতে পারবেন, সাঁওতালি ও বাংলা ভাষার বিন্দুবিসর্গ না জেনে? খাতায় কলমে পারবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা কি সত্যিই কিছু শিখবে তাঁর ক্লাসে? স্কুলশিক্ষার দুরবস্থা কি তাতে বাড়বে না আরও?

কেন্দ্রের ভ্রান্ত নীতিই এর জন্য দায়ী। একলব্য স্কুলগুলি আজকের নয়, নব্বই দশকের শেষে প্রায় দু’শোটি স্কুল গড়ে উঠেছিল কেন্দ্র-রাজ্য একত্র উদ্যোগে। সেখানে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি ছাড়া হয়েছিল রাজ্য সরকারের হাতেই, কারণ রাজ্যের প্রান্ত ও প্রত্যন্তের ভাষা-সংস্কৃতির হালহদিস জানা এবং সেই মতো জনজাতি গোষ্ঠীর স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ রাজ্যের পক্ষে সহজ। কিন্তু অমৃতকালের ভারতে এখন সবই কেন্দ্রমুখী, প্রশাসন শিক্ষা সংস্কৃতি চাকরি সর্বত্র হিন্দির হাওয়া, জনজাতি গোষ্ঠীর স্কুলগুলোই বা ব্যতিক্রম হবে কেন। স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে দক্ষতা ও জ্ঞান কেন এই স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগে মাপকাঠি হবে না, তার সঙ্গে অবশ্য অন্য প্রশ্নও ওঠে— বিশেষ কোনও ধর্মীয় সংস্কৃতির আদলে শিক্ষাদীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না। রাজনৈতিক বিরোধিতা ছাপিয়ে এই প্রশ্নগুলি আরও বেশি ওঠা দরকার জনপরিসরেও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE