খারাপ খবর সচরাচর একা আসে না। ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, এবং শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির শ্লথ গতির খবরও একই সঙ্গে পাওয়া গেল। তার কয়েক দিনের মধ্যেই জানা গেল যে, পাইকারি মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতিও বেলাগাম হয়েছে। ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মতে, ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির গ্রহণযোগ্য হার হল দুই থেকে ছয় শতাংশ। জানুয়ারি মাস থেকেই ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ব্যাঙ্কের গ্রহণযোগ্য সীমার উপরে ছিল। মার্চ মাসে তা পৌঁছে গেল প্রায় সাত শতাংশে। পেট্রোলিয়ামের দাম নয়, এই মূল্যবৃদ্ধির পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান খাদ্যপণ্যের দামের। খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক কনজ়িউমার ফুড প্রাইস ইনডেক্স মার্চে বৃদ্ধি পেয়েছে ৭.৬৮ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৮৫ শতাংশ। ভোজ্য তেল থেকে আনাজ, মাছ-মাংস, সবের দামই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। পাইকারি মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতির হার মার্চে পৌঁছে গেল ১৪.৫৫ শতাংশে। এই বৃদ্ধির পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে
পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধির। গত মার্চের তুলনায় এই মার্চে পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৩৪.৫ শতাংশের বেশি। এই সংবাদটির পরতে পরতে লুকোনো রয়েছে বৃহত্তর দুঃসংবাদ— আগামী কয়েক মাসে সাধারণ ক্রেতার গায়ে মূল্যবৃদ্ধির আঁচ লাগতে চলেছে আরও বেশি করে, কারণ পেট্রোপণ্যের বর্ধিত দামের পুরো প্রভাব মার্চের ভোগ্যপণ্য সূচকে পড়েনি, তা পড়বে পরবর্তী মাসগুলিতে। পরিবহণের ব্যয়বৃদ্ধির ফলে খাদ্যপণ্য-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দামও বাড়বে। পাশাপাশি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘কমোডিটি প্রাইস’ যে ভাবে বেড়েছে, তার প্রভাবও পড়বে।
মূল্যস্ফীতির এই আঁচ কার গায়ে লাগছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষের আয় এখনও অতিমারির ধাক্কা সম্পূর্ণ সামলে উঠতে পারেনি। তার উপরে এই বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধি তার ক্রয়ক্ষমতাকে আরও সঙ্কুচিত করেছে। সেই সঙ্কোচনের একটি প্রমাণ মিলবে শিল্প উৎপাদনের সূচকেও। মার্চ মাসে এই সূচকের বৃদ্ধির হার যৎসামান্য, কিন্তু তারই মধ্যে দু’টি ক্ষেত্রে উৎপাদনের সঙ্কোচন ঘটেছে। ক্ষেত্র দু’টি যথাক্রমে কনজ়িউমার ডিউরেবলস, এবং কনজ়িউমার নন-ডিউরেবলস। অর্থাৎ, যে ক্ষেত্রগুলির উৎপাদন সরাসরি সাধারণ ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত, প্রত্যক্ষ ধাক্কা লেগেছে সেই ক্ষেত্রগুলিতেই। গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সচরাচর শহরের তুলনায় কম অনুভূত হয়, কারণ অন্তত খাদ্যের ক্ষেত্রে গ্রামে বাজার-বহির্ভূত একটি ব্যবস্থা কাজ করে। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে গ্রামাঞ্চলেও ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার সরাসরি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। ক্রেতার নাভিশ্বাস উঠছে। এই মূল্যস্ফীতির প্রভাব ক্রয়ক্ষমতার পথ বেয়ে অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হারে স্বভাবতই প্রভাব ফেলবে।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ইতিমধ্যেই জানিয়েছে যে, আর্থিক বৃদ্ধির হার নয়, অতঃপর তাদের প্রধান লক্ষ্য হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এখনও সুদের হার বাড়েনি বটে, কিন্তু তা যে নিছকই সময়ের অপেক্ষা, সে বিষয়ে সংশয় নেই। মূল্যস্ফীতির হার এমন বেলাগাম হলে ব্যাঙ্কের হাতে উপায়ান্তরও নেই— বিশেষত যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রায় সব বড় অর্থব্যবস্থাই বর্ধিত সুদের হারের পথে হাঁটছে। কিন্তু, অর্থব্যবস্থা যখন সবে ঘুরে দাঁড়াতে আরম্ভ করেছিল, তখনই সুদের হার বাড়লে, অর্থাৎ ঋণ মহার্ঘতর হলে, লগ্নিতে ফের ভাটা পড়বে, তাও প্রশ্নাতীত। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ যদি কেন্দ্রীয় সরকারের ভ্রান্ত নীতির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেন, তাঁকে দোষ দেওয়ার উপায় নেই। যখন প্রয়োজন ছিল মানুষের হাতে আয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে অর্থব্যবস্থায় চাহিদাবৃদ্ধির, তখন কেন্দ্রীয় সরকার ঋণের জোগান বাড়ানোর পরোক্ষ পথে হাঁটল। এখন চাহিদাও নেই, ঋণও দুর্মূল্য হতে চলেছে— অর্থব্যবস্থাকে সামলায় কে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy