Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Democracy

টিনের তলোয়ার

পশ্চিমবঙ্গে তথ্য কমিশনের নিকট সাড়ে সাত হাজারেরও অধিক আবেদন পড়িয়া রহিয়াছে, নিষ্পত্তির হার লজ্জাজনক।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২১ ০৫:৫৩
Share: Save:

সিসিফাস দৈত্যের পর্বতশীর্ষে প্রস্তর তুলিবার নিরন্তর চেষ্টার ন্যায়, ভারতীয় নাগরিকের অধিকার অর্জনের প্রয়াসও কি এক অন্তহীন সংগ্রাম হইয়া থাকিবে? অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ ও পরিশ্রমে গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষার যে প্রতিষ্ঠানগুলি নির্মিত হইয়াছিল, সেইগুলি নিষ্ক্রিয়, নিষ্ফল রহিয়া গেল। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের তথ্য কমিশনের সক্রিয়তার যে বিবরণ সম্মুখে আসিয়াছে, তাহাতে অতি উদ্যমী ব্যক্তিরও হতাশা আসিতে পারে। কোনও সরকারি দফতর বা প্রকল্প সম্পর্কে কোনও তথ্য দাবি করিলে তাহা পাইতে গড়ে সাড়ে সাত বৎসর সময় লাগিবে। যদিও তথ্যের অধিকার আইন অনুসারে, নাগরিকের আবেদন গৃহীত হইবার ত্রিশ দিনের মধ্যে নাগরিককে তথ্য সরবরাহ করিতে সরকার বাধ্য। পশ্চিমবঙ্গে তথ্য কমিশনের নিকট সাড়ে সাত হাজারেরও অধিক আবেদন পড়িয়া রহিয়াছে, নিষ্পত্তির হার লজ্জাজনক। তথ্য না দিবার জন্য সরকারি আধিকারিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার হারও অতি সামান্য। এক গবেষক স্বয়ং আবেদনের পর আড়াই বৎসরেও প্রয়োজনীয় তথ্য না পাইয়া তথ্য কমিশনের বকেয়া মামলাগুলির বিশ্লেষণ করিয়া এই চিত্র পাইয়াছেন।

ছবিটি অতি হতাশাজনক হইতে পারে, কিন্তু ব্যতিক্রমী নহে। ২০২০ সালে তথ্যের অধিকার আইনের পনেরো বৎসর হইল। সেই উপলক্ষে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট সারা দেশে তথ্য কমিশনগুলির নিষ্ক্রিয়তার অনুরূপ চিত্রই পাইয়াছিল। বিপুল বকেয়া মামলা, সামান্য নিষ্পত্তি, নগণ্য ক্ষতিপূরণ, এবং আইন-উপেক্ষাকারী আধিকারিকদের সহজ নিষ্কৃতি, এই সব মিলিয়া তথ্যের অধিকারকে অর্থহীন করিয়া তুলিয়াছে। যাহা হইতে পারিত নাগরিকের ব্রহ্মাস্ত্র, তাহা টিনের তলোয়ার হইয়া রহিয়াছে। রাষ্ট্রশক্তির সম্মুখে তাহা নাগরিকের শক্তির প্রতীকী ঘোষণামাত্র। অথচ, যে আন্দোলনের মাধ্যমে তথ্যের দাবি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় করিয়াছিল, রাজস্থানের পঞ্চায়েত কর্তাদের বিরুদ্ধে মজদুরদের সেই প্রতিবাদ কেবল দেখাইবার বস্তু ছিল না। সেই আন্দোলনের শক্তি দ্রুত প্রসারিত হইয়াছিল। তথ্যের দাবি যে কার্যত গণতন্ত্রে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার দাবি, সেই সত্যকে উপেক্ষা করিতে পারে নাই রাষ্ট্র। তথ্যের অধিকার আইন পাশ হইল ২০০৫ সালে। তাহা বাস্তবিক কার্যকর হইলে এত দিনে প্রশাসনের রূপটি বদলাইত। সরকারি প্রকল্পের পরিষেবাগুলি নেতাদের দানের সামগ্রী, কিংবা রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ঘুঁটি হইয়া থাকিতে পারিত না। সরকারি আধিকারিকও বুঝিতেন, মন্ত্রীদের তুষ্টিবিধান তাঁহার কর্তব্য নহে, স্বচ্ছ ও তৎপর পরিষেবা প্রদানই তাঁহার কাজ। কর্তব্যে অবহেলা হইলে সেই ত্রুটি ধরা পড়িবে, শাস্তিও মিলিবে— তথ্যের অধিকার আইনের দ্বারাই তাহা নিশ্চিত করিবেন নাগরিক।

যে নেতারা নীতিনিষ্ঠ, যে সরকারি কর্মীরা কর্তব্যপরায়ণ, তাঁহাদের সহিত সত্যের অধিকার আইনের কোনও বিরোধ নাই। কিন্তু, যাঁহারা দুর্নীতির অস্বচ্ছ পথের পথিক, চরিত্রগত ভাবেই এই আইন তাঁহাদের স্বার্থের পরিপন্থী। ফলে, আইনটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটি যদি তেমন নেতা-আমলাদের হাতে ন্যস্ত হয়— অথবা, তথ্য কমিশন নামক ধোঁকার টাটি খাড়া করিয়া রাখা হয়, যাহা চালিত হয় নেতা-মন্ত্রীদের অঙ্গুলিহেলনে— তবে আইনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইতে বাধ্য। এই আইনটি গণতন্ত্রের শিরদাঁড়া হইতে পারে— কিন্তু, তাহার জন্য আইনটির নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। তথ্য কমিশনটি যাহাতে কোনও ভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেই কাজটি করিবে কে? এইখানেই গণতন্ত্রের ভূমিকা, আন্দোলনের তাৎপর্য। যত ক্ষণ অবধি তথ্য কমিশন প্রকৃতার্থে নিরপেক্ষ হইতেছে, তত ক্ষণ অবধি আন্দোলন চালাইয়া যাওয়াই গণতন্ত্রের অংশীদারদের কর্তব্য। মানুষের চাপই পারে ব্যবস্থাটিকে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ করিয়া তুলিতে।

অন্য বিষয়গুলি:

India Democracy NHRC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy