ভারত নামক দেশটি ২০২৩ সালটা আপাতদৃষ্টিতে যথা পূর্বং তথা পরম্ ছন্দেই কাটিয়ে দিল। বলা বাহুল্য, নাটকীয় ঘটনার অভাব ছিল না। সুনাট্য এবং কুনাট্য, দুই গোত্রেরই নানা দৃষ্টান্ত রচিত হয়েছে। যেমন, এক দিকে চন্দ্রযানের সফল অবতরণ, অন্য দিকে সংসদ থেকে বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের পাইকারি বহিষ্কার। নিরবচ্ছিন্ন কুনাট্যরঙ্গে গড্ডলিকাপ্রবাহ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের অবশ্য কোনও তুলনা নেই— শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ‘ধর ধর ওই চোর’ নামক যাত্রাপালাতেই এ রাজ্যের নাগরিকদের বছর ঘুরে গেল। কিন্তু সর্বভারতীয় মানচিত্রেও বিশেষ বিশেষ ঘটনার গণ্ডি ছেড়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের বড় ছবির দিকে তাকালে উত্তাল সমুদ্র বা পাহাড়ি ঝোরার বদলে সমতলের কোনও মাঝারি মাপের নদীর কথাই মনে পড়া স্বাভাবিক। সমতলের নদীকে হেয় করার কোনও কারণ নেই। নাটকীয়তা না থাকা অনেক সময়েই স্বস্তিকর। বিশেষত, টালমাটাল বিশ্ব বাজারের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থা যে মোটের উপর স্থিতিশীল, তার গুরুত্ব কম নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের চালকরা তাঁদের সীমিত বোধবুদ্ধি এবং স্বভাবসিদ্ধ অতিনাটকীয়তার অনুপ্রেরণায় ভারতের অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে অবান্তর বাগাড়ম্বর করে চলেছেন, ভোট যত কাছে আসবে সেই অতিকথনের মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়বে, সে-সব ধর্তব্য নয়। বহির্বিশ্বে বড় সঙ্কট দেখা দিলে এই সুস্থিতি বজায় রাখাও কঠিন হবে। কিন্তু আপাতত বলা চলে, ঢিমে তেতালায় অর্থনীতির যাত্রা জারি আছে।
প্রশ্ন হল, সেই যাত্রাপথে দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিকের জীবন ও জীবিকার গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলির কতটুকু সুরাহা হয়েছে? দারিদ্র, বুভুক্ষা, অপুষ্টি, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্যের মাপকাঠিতে বিভিন্ন সমীক্ষালব্ধ তালিকায় এই দেশ যে অতলে সেই অতলেই থেকে গিয়েছে। দিল্লীশ্বরেরা এবং তাঁদের ধামাধরা ‘বিশেষজ্ঞ’ বাহিনী অন্যান্য বছরের মতোই এ বারেও এমন যে কোনও তালিকা প্রকাশ পাওয়ামাত্র ‘হয়নি হয়নি, ভুল’ রব তুলে সমীক্ষাগুলিকে উড়িয়ে দিতে তৎপর হয়েছেন, কিন্তু সত্য সে যে সুকঠিন। কেন্দ্রীয় সরকার শত চেষ্টাতেও এই সংবাদ গোপন করতে পারেনি যে বেকারত্বের মাত্রা উদ্বেগজনক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উদ্বেগ আরও অনেক বেশি, কারণ প্রচলিত পরিসংখ্যানে প্রকৃত সঙ্কট ধরা পড়ে না— পরিসংখ্যানে যাঁরা ‘বেকার’ নন, তাঁদের এক বিরাট অংশ যে কাজ করছেন তা প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে কোনও ক্রমে বেঁচে থাকার উপায়মাত্র। নির্মম সত্য এই যে, অর্থনীতির আপাত-অগ্রগতির পনেরো আনা সুফল কুড়িয়ে চলেছেন মুষ্টিমেয় সৌভাগ্যবান বর্গের মানুষ, অধিকাংশের দুর্দশা ক্রমশই ঘোরতর আকার ধারণ করছে। এই অস্বাভাবিক এবং বেলাগাম অসাম্যই এখন স্বাভাবিক বলে গণ্য হচ্ছে। এ বড় সুখের সময় নয়।
অস্বাভাবিককে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়ার এই বাস্তবটি গত এক বছরে গভীরতর অর্থেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সংসদীয় ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক নির্বাচন এবং সংবিধানের ভূমিকা আপাতদৃষ্টিতে বহাল রেখেও দেশের শাসনতন্ত্র চোখের সামনে নির্ভেজাল আধিপত্যবাদের অন্ধকারে আরও অনেক দূর তলিয়ে গিয়েছে। কাশ্মীর থেকে অযোধ্যা, সর্বত্র এক হাড়-হিম-করা শান্তিকল্যাণের মধ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে সেই আধিপত্য আস্বাদন করছেন শাসকরা, সমস্ত ভিন্নমতকে বিলুপ্ত করাই যাঁদের প্রকৃত লক্ষ্য, প্রশ্ন তোলাও যাঁদের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহের নামান্তর। সজাগ বিচারবিভাগ এখনও ভারতীয় গণতন্ত্রের পূর্ণগ্রাস ঘটতে দেয়নি, কিন্তু ২০২৩ সাল বারংবার বুঝিয়ে দিয়েছে যে, কেবলমাত্র আদালতের ভরসায় গণতন্ত্র বাঁচে না। তার একটি কারণ বিচারবিভাগের এক্তিয়ার বা দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা, কিন্তু আরও অনেক বড় কারণ, সংসদীয় ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপুল দাপট, শাসকেরা চাইলে যে দাপটকে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে পারেন। সর্বোচ্চ আদালতের মত কার্যত অগ্রাহ্য করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের নিয়ম সম্প্রতি যে ভাবে পাল্টে দেওয়া হল, কিংবা বহুলাংশে ‘বিরোধী-মুক্ত’ সংসদে যে ভাবে ন্যায় সংহিতা পাশ হয়ে গেল, তা এই সত্যেরই প্রমাণ। অথচ এই সমস্ত ঘটনাক্রমই যেন গতানুগতিক বলে স্বীকৃত হয়েছে, বিক্ষিপ্ত, সাময়িক এবং মামুলি প্রতিবাদের বাইরে সমাজে ও রাজনীতিতে কোনও তরঙ্গ তোলেনি। ভারতীয় গণতন্ত্র কি নির্বিবাদে একাধিপত্যের কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করছে? বর্ষশেষে হাতে রইল এই প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy