বিজয়ী যুধিষ্ঠির রাজ্যচালনার কৌশল জানিতে চাহিয়াছিলেন ভীষ্মের নিকট, যিনি প্রতিপক্ষের পরাজিত সেনানায়ক। কৃষক আন্দোলনের নিকট নতিস্বীকারের পর নরেন্দ্র মোদী যদি কৃষকদের কাছেই সিঙ্ঘু, টিকরি ও গাজিপুর সীমান্তে মৃতদের সংখ্যা জিজ্ঞাসা করিতেন, তাহা শাসকের উপযুক্ত কাজ হইত। সরকার তাহা করে নাই। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী সংসদে জানাইয়াছেন, কৃষকমৃত্যু সম্পর্কে কোনও তথ্যই নাই সরকারের নিকট। অতএব কৃষক আন্দোলনে মৃতদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারিবে না কেন্দ্র। ইহাতে কৃষকরা ক্ষুব্ধ হইয়াছেন। প্রবল শীতে বা অত্যধিক তাপমাত্রায় অসুস্থ হইয়া অনেক কৃষক প্রাণ হারাইয়াছেন; কেহ বা অবসাদে আত্মহত্যা করিয়াছেন। পঞ্জাবের কংগ্রেস সরকার দেড়শতেরও অধিক মৃত কৃষকের পরিবারকে ইতিমধ্যেই ক্ষতিপূরণ দিয়াছে; কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী চারশতাধিক মৃতের নামের তালিকা প্রকাশ করিয়াছেন। কেবল কেন্দ্র কৃষকমৃত্যু বিষয়ে অন্ধকারে রহিল, ইহা বড়ই আশ্চর্যের। যে কৃষকদের সহিত খলিস্তানিদের সংযোগের ‘খবর’ পাইয়াছিলেন শাসক দলের নেতারা, তাঁহাদের মৃত্যুর খবর ক্ষমতার অলিন্দ অবধি পৌঁছাইল না? মনে হইতে বাধ্য যে, কেন্দ্রের এই অজ্ঞানতার প্রকাশ কেবল প্রশাসনিক কাজে ভ্রান্তিস্বীকার নহে। তেমন হইলে স্বীকারোক্তিতে লজ্জার প্রকাশ থাকিত। আর্থিক দায় এড়াইবার চেষ্টাও এই তথ্যহীনতার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হইতে পারে না। কৃষক আন্দোলন ও বিরোধী দলগুলি যে সরকারকে ওই মৃত্যুগুলির কথা বার বার মনে করাইয়া ক্ষতিপূরণের দাবি তুলিবে, তাহা না জানিবার কথা নহে শাসকের।
কৃষকমৃত্যুর সংবাদ সরকার রাখে নাই— কৃষিমন্ত্রীর এই বক্তব্যে যে মূল সুরটি ফুটিয়াছে, তাহা তাচ্ছিল্যের। যেন ওই লোকগুলি অকিঞ্চিৎকর— তাহারা বাঁচিল কি মরিল, সেই খোঁজ রাখিবার প্রয়োজন নাই। এই মনোভাব নূতন নহে। এমন ভাবেই কেন্দ্র গত বৎসর সেপ্টেম্বরে সংসদে জানাইয়াছিল যে, কত পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরিবার পথে দুর্ঘটনায় অথবা পথশ্রমে প্রাণ হারাইয়াছেন, তাহার তথ্য নাই, অতএব ক্ষতিপূরণেরও প্রশ্ন নাই। তেমনই, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অক্সিজেনের অভাবে কত জনের মৃত্যু হইয়াছে, সে সম্বন্ধে কেন্দ্রের কোনও ধারণা নাই, লোকসভায় জানাইয়াছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডবিয়া। অতিমারিতে কত লোক কাজ হারাইয়াছেন, কত জন রেশনের মতো অত্যাবশ্যক পরিষেবা হইতে বঞ্চিত হইয়াছেন, এমন বহু অত্যাবশ্যক তথ্য নাগরিক সমাজ যথাসাধ্য সংগ্রহ করিয়াছে। কেন্দ্র অতি বিলম্বে, অতি সামান্য তথ্য দিয়াছে, অথবা জানাইয়াছে যে, তথ্য নাই। অথচ, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় নাগরিকের উপর নিয়ত নজরদারি, ব্যক্তির অনবধানে তাহার তথ্য সংগ্রহের জন্য নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ উঠিয়াছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা যে নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তাহা মনে করাইতে হইয়াছে শীর্ষ আদালতকে। অপর দিকে, যে তথ্যগুলি না থাকিলে নাগরিক অধিকার, মানবাধিকারের সুরক্ষা সম্ভব নহে, তাহার কিছুই রাখে নাই কেন্দ্র।
এই অজ্ঞানতার উৎস অবশ্যই ত্রুটি স্বীকার করিবার অনিচ্ছা। কৃষকদের সহিত রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় ব্যর্থতা, স্বাস্থ্য পরিষেবার অপ্রতুলতা, শ্রমিক সুরক্ষায় গাফিলতি স্বীকার করিতে রাজি নহে সরকার। অতএব মৃত বা বিপন্ন কৃষক, শ্রমিক, করোনা-আক্রান্তদের হিসাব না রাখিয়া আপন অপদার্থতার সাক্ষ্য মুছিতে চাহে। যেন মাথা কাটিয়া মাথাব্যথার উপশম। তৎসহ একটি গভীরতর অক্ষমতাও কি নাই? জানিতে চাহিলে প্রশ্ন করিতে হয়— সেখানে প্রশ্নকর্তা প্রার্থী, কৃষক-শ্রমিক দাতা। শাসকের আসন হইতে নামিয়া নাগরিকের নিকট তথ্য প্রার্থনা করিবার জন্য যে বিনয় ও সততা প্রয়োজন, এই শাসকদের তাহা নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy