প্রতীকী ছবি।
একচল্লিশ বৎসর পর কারাগার হইতে মুক্তি পাইলেন দীপক জোশী। তাঁহার এই চার দশকের বন্দিদশা সম্পূর্ণ বিনা বিচারে কাটিয়াছে। বয়ঃপ্রাপ্তির পর চার দশক: প্রায় এক সমগ্র জীবৎকাল। সংবাদে প্রকাশ, ১৯৮০ সালে এক খুনের অভিযোগে দীপককে আটক করিবার স্বল্প কালের মধ্যেই তাঁহার মানসিক স্থিতি নষ্ট হইয়া যায়। মানসিক ভারসাম্যহীন বন্দিদের বিচারপ্রক্রিয়া সাধারণত থমকাইয়া যায়— দীপকও কারাগারের ভিতরে আটকাইয়া পড়েন। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার প্রধানতম দার্শনিক অবস্থানগুলির একটি হইল, অতি সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ধারা ব্যতিরেকে যে কোনও মামলাতেই অভিযোগ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে নিরপরাধ গণ্য করিতে হইবে। প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে, দীপক জোশীর ক্ষেত্রে সেই সাধারণ আইনি নীতির কী হইল? বস্তুত, আধুনিক গণতন্ত্রে ইহা মৌলিক অধিকারস্বরূপ স্বীকৃত, মানবাধিকার বা নাগরিক অধিকার বিষয়ক একাধিক আন্তর্জাতিক ঘোষণায় ইহা স্পষ্ট ভাবে জ্ঞাপন করা হইয়াছে। কিছু দিন পূর্বে দিল্লি হাই কোর্ট অতি ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষেত্র বাদে অন্য অভিযুক্তদের স্বপ্রবৃত্ত জামিন মঞ্জুরির অধিকারের প্রসঙ্গে বলিয়াছিল, উহা ব্যক্তিস্বাধীনতার অবিচ্ছিন্ন অংশ।
এ দিকে আদালত আইন মোতাবেক দীপকের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করিয়াছে— পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ। আইনজীবী জানাইয়াছেন, উক্ত আইনে ইহাপেক্ষা অধিক ক্ষতিপূরণের সংস্থান নাই। ইহাই হয়তো স্বাভাবিক, আইন অনুযায়ী যথাযথ। কিন্তু প্রশ্ন উঠিবে, কিসের ক্ষতি? কিসের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা? ইহাই কি এক জন মানুষের সারা জীবনের ‘ক্ষতি’র দাম? এত দিন বিনা বিচারে কারাবাসের কি সত্যিই কোনও ক্ষতিপূরণ হয়? ক্ষতি কথাটি নানা প্রসঙ্গে ব্যবহারযোগ্য, কিন্তু যাঁহার জীবন হইতে একচল্লিশটি বৎসর প্রশাসনিক অবহেলায় উবিয়া গেল, তাঁহার ক্ষেত্রে শব্দটির সীমা লইয়া কি নীতিগত ভাবে চিন্তার জায়গা নাই? দীপকের সহিত যাহা ঘটিয়াছে, তাহা ব্যক্তির জীবনের উপর রাষ্ট্রের অধিকারের সীমার প্রশ্ন উঠাইয়া দেয়। যখন এক ব্যক্তির অপরাধ বিচার-প্রক্রিয়ায় প্রমাণিতও নহে, তাঁহার জীবন কেবল আইনের গেরোয় গরাদের আড়ালে কাটিয়া গেলে রাষ্ট্রের তরফে তাঁহাকে কী দিবার কথা? ক্ষতিপূরণ? না কি রাষ্ট্রীয় অপরাধের স্বীকৃতি?
ইহা একটিমাত্র ঘটনা নহে। ভারতে বিচারপ্রক্রিয়ার নামে নাগরিকের উপর কত ধরনের অবিচার চলে, এই ঘটনা তাহার একটিমাত্র উদাহরণ। যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশে অপরাধীরও মৌলিক মানবাধিকার থাকিবার কথা। অথচ ভারতীয় গণতন্ত্রে অপরাধ প্রমাণিত না হইলেও কোনও ব্যক্তির উপর এ-হেন নির্যাতন চলে। যে কোনও উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের দিকে তাকাইলে বোঝা যায়, অপরাধীর সহিত সাধারণ ভাবে মানবিক ব্যবহারের কী প্রকার দৃষ্টান্ত সেখানে উপস্থিত। ভারতীয় রাষ্ট্র যে এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে এতখানি পিছাইয়া আছে, তাহা বিরাট দুর্ভাগ্য। দেশের রাজনীতিকদের এই সকল ‘তুচ্ছ’ বিষয়ে মাথা ঘামাইবার সময় নাই। মানবাধিকার বিষয়টিই সাধারণত তাঁহাদের নিকট গৌণ, তাহার উপর মানসিক ভারসাম্যহীন এক জন অভিযুক্ত বন্দি হয়তো তাঁহাদের চোখে যথেষ্ট অধিকারসম্পন্ন মানবও নহেন! বিষয়টি লইয়া একমাত্র অল্পবিস্তর মাথা ঘামাইতে পারেন দেশের নাগরিকরা— ঘামাইবেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy