ভারতীয় সংবিধান প্রবর্তনের বর্ষপূর্তির এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আর একটি ইতিহাসও স্মরণীয়। স্বাধীন দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সাত দশক পূর্ণ হইতেছে এই বৎসরেই। নির্বাচন গণতন্ত্রের একমাত্র অঙ্গ নহে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করিতে তাহার সীমাবদ্ধতা সমকালীন ভারতে অতিমাত্রায় প্রকট। কিন্তু নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি আবশ্যিক অঙ্গ; ভারত— সত্তরের দশকের জরুরি অবস্থার ব্যতিক্রম সাপেক্ষে— নিয়মিত নির্বাচনে অভ্যস্ত বলিয়াই হয়তো তাহা যথেষ্ট মনে রাখে না, কিন্তু দুনিয়ার বহু দেশের নাগরিকরাই আপন অভিজ্ঞতায় মর্মে মর্মে বুঝিয়াছেন, নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনপ্রতিনিধি স্থির করিতে আপন সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করিবার অধিকার কতখানি মূল্যবান। দেশের বর্তমান শাসকরা সচরাচর নির্বাচনকে নিছক ক্ষমতা দখলের প্রকরণ হিসাবে যথেচ্ছ ব্যবহার করিতে ব্যগ্র। নির্বাচনের প্রকৃত গণতান্ত্রিক মহিমা অনুধাবনের সামর্থ্য বা ইচ্ছা তাঁহাদের কতটুকু আছে, বলা শক্ত। প্রথম সাধারণ নির্বাচনের ইতিহাস স্মরণের তাগিদ তাঁহাদের না-থাকাই স্বাভাবিক।
সেই ইতিহাসের একটি পাদটীকা স্মরণীয়। প্রথম নির্বাচন ১৯৫২ সালে সম্পন্ন হইয়াছিল বটে, কিন্তু তাহা শুরু হইয়াছিল ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে। হিমাচল প্রদেশে আগাম ভোটগ্রহণ করা হয়— তাহার পরে দীর্ঘ সময় প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সেই অঞ্চল দুর্গম হইয়া পড়ে। ঘটনাটি শুনিতে সামান্য, কিন্তু তাহার তাৎপর্য অসামান্য। এই একটি ঘটনা জানাইয়া দেয়, ভারত বহুত্বের দেশ এবং সেই বহুত্বকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়াই ভারতীয় গণতন্ত্র চরিতার্থ হইতে পারে। কথাটি এখন অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক, কারণ শাসকরা এই বহুত্বকেই সমস্ত দিক হইতে খর্ব করিয়া সমগ্র দেশ ও তাহার সমাজকে একটি একমাত্রিক আধিপত্যের ছাঁচে ঢালিতে বদ্ধপরিকর। চরম এককেন্দ্রিকতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করিতে তাঁহারা কেবল বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলিকে নানা ভাবে দমন ও পীড়ন করিতে তৎপর নহেন, সামগ্রিক ভাবেই রাজ্যের স্বাধিকার খর্ব করিয়া কেন্দ্রের দাপট বাড়াইতে চাহেন। তাঁহারা মনে করেন, সর্বশক্তিমান কেন্দ্রীয় সরকারই দেশের শক্তি ও সামর্থ্যের পক্ষে জরুরি এবং যথেষ্ট।
এই ধারণা সর্বৈব ভ্রান্ত এবং বিপজ্জনক। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি নিহিত আছে তাহার যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ধর্মে। সেই ধর্ম কেবল সংবিধানের অক্ষরে চরিতার্থ হইতে পারে না, নিরন্তর অনুশীলনের পথেই তাহার মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব। সংবিধান রচয়িতারা তাহা জানিতেন, দেশের রাষ্ট্রনায়করা অনেক দিন অবধি তাহা মানিয়া চলিতেন। ত্রুটি হইত, বিচ্যুতি ঘটিত, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর আগে অবধি বৃহৎ ও ধারাবাহিক স্বধর্মচ্যুতি ঘটে নাই, আবার তাঁহার পরবর্তী কালেও যুক্তরাষ্ট্রীয়তা অনেকখানি ফিরিয়া আসিয়াছিল। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় সেই ধারা সম্পূর্ণ বিনষ্ট। তাহার ফলে শাসকদের সমস্যাও বাড়িতেছে। একটি প্রকট উদাহরণ নাগরিকত্বের ধারণা সংশোধনের চেষ্টা। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্ররোচনায় তাঁহারা এই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হন, অথচ অতি দ্রুত তাঁহারাও টের পান যে বিভিন্ন রাজ্যে তাহার প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন, অনেক সময়েই বিরূপ। আবার, পশ্চিমবঙ্গে তাঁহাদের নির্বাচনী ব্যর্থতাও ছিল একটি গভীর অর্থে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার জয়, যে যুক্তরাষ্ট্রীয়তা অন্য পরিপ্রেক্ষিতে মহারাষ্ট্রে তাঁহাদের প্রতিহত করিয়াছে, প্রতিহত করিয়াছে দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায়, ওড়িশায়, এমনকি অংশত বিহারেও। শাসকরা এই অভিজ্ঞতা হইতে কী শিখিবেন, তাঁহারাই জানেন। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতি যাঁহাদের শ্রদ্ধা আছে, তেমন সমস্ত দল বা গোষ্ঠীকেই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের এই স্বধর্মকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দিতে হইবে। তাহার উপরেই নির্ভর করিতেছে প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy