ফাইল চিত্র।
ফাদার স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামীর মৃত্যু ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত মুখটি দেখাইয়া দিল। বুঝাইল, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিকতা কত দূর ধ্বংসপ্রাপ্ত। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি ব্যক্তি-অধিকার। অথচ গত কয়েক বৎসরে বার বার তাহাকে পিষিয়া, শ্বাসরোধ করিয়া ভারতীয় রাষ্ট্র স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে যে, এই দেশ গণতন্ত্রের পথ হইতে এক ভিন্ন অভিমুখে যাত্রা করিতেছে। এক জন চুরাশি বৎসরের অসুস্থ মানুষকে জাতীয় তদন্ত সংস্থা জাতীয় নিরাপত্তা আইনে বন্দি করিয়াছে, এবং গত ন’মাসে চার বার তাঁহার জামিনের আবেদন অস্বীকার করিয়াছে। মে মাসে শেষ শুনানির সময় কঠিন পারকিনসন্স রোগে জীর্ণ অশক্ত জেলবন্দি ফাদার নিজের অবস্থা সম্পর্কে বলিয়াছিলেন, এমনই যদি চলিতে থাকে, খুব তাড়াতাড়ি জেলের মধ্যেই তাঁহাকে প্রাণত্যাগ করিতে হইবে। ঠিক তাহাই হইল, দুই মাস কাটিবার আগেই। এই চরম লজ্জার দায় কে লইবে— এ প্রশ্ন করিবার অবকাশও আজ নাই। কেননা যাঁহাদের উত্তর দিবার কথা, সেই দণ্ডমুণ্ডের কর্তারাই অবিশ্রাম প্রচেষ্টায় ভারতীয় গণতন্ত্রকে এই অন্ধকার পাতালে টানিয়া আনিয়াছেন, যেখানে অসুস্থ বৃদ্ধের অধিকারকেও ন্যূনতম মর্যাদা না দিয়া, রাষ্ট্রের ঝান্ডা সদর্প নির্লজ্জতায় উড়িতে থাকে। স্ট্যান স্বামী কী অপরাধে অপরাধী ছিলেন, এখনও তাহা প্রমাণের অপেক্ষায়। কিন্তু ভারতীয় রাষ্ট্রের অপরাধ আজ প্রমাণিত, বিশ্বজনগোচর।
প্রধান দায়টি লইতে হইবে বিচারবিভাগকেই। দুর্ভাগ্যজনক এই সত্য, কেননা বর্তমান কালে বিচারবিভাগকেই নাগরিক তাঁহার অধিকার রক্ষার শেষ সহায় বলিয়া জানেন। ভীমা-কোরেগাঁও মামলার সহিত যুক্ত বলিয়া যখন স্ট্যান স্বামীকে গ্রেফতার করা হয়, তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আদিবাসীদের অধিকাররক্ষায় তিনি সরব। এই ‘অপরাধ’ কত বড়, তাহাতে এহেন এক গুরুতর অসুস্থ বর্ষীয়ান নাগরিককে মাসের পর মাস বিনা জামিনে বন্দি করিয়া রাখা উচিত কাজ কি না, বিচারবিভাগেরই ভাবিবার কথা ছিল। তিনি কি এতই প্রভাবশালী কিংবা ক্ষমতাশালী যে, তাঁহাকে জামিন দিলেই রাষ্ট্রের বিপদ ঘটিত? জামিন যে কোনও ব্যক্তিনাগরিকের ‘অধিকার’— যত ক্ষণ পর্যন্ত না তিনি ব্যতিক্রমী রকম ‘বিপজ্জনক’ বলিয়া সাব্যস্ত— এই গণতন্ত্র-স্বীকৃত কথাটি কি ভারতীয় বিচারবিভাগের নীতি-পুস্তিকা হইতে কাটা পড়িয়াছে? হাতে গেলাস ধরিতে পারেন না বলিয়া তাঁহাকে জল খাইবার জন্য ‘সিপার’ দিবার আবেদন করা হইয়াছিল, বিচারকরা অনুমতি দেন নাই। কে জানে, বস্তুটি পাইলে বৃদ্ধ অভিযুক্ত হয়তো রাষ্ট্রের পক্ষে আরও কয়েক কাঠি বিপজ্জনক হইয়া উঠিতেন!
‘প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা’ শব্দটি সাধারণত অধিকার-আন্দোলনকারীদেরই পছন্দসই। স্ট্যান স্বামীর ক্ষেত্রে অবশ্য শব্দটি একশত শতাংশ সত্য ও সঙ্গত। বিচারে অযথা বিলম্ব আসলে অবিচারেরই নামান্তর। কাহারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকিলে বিচার হইবার কথা, এবং বিচারে অপরাধ প্রমাণিত না হইলে অভিযুক্তের মুক্তি পাইবার কথা। কোনও যুক্তিতেই বিনা বিচারে দিনের পর দিন কাহাকেও আটকাইয়া রাখা গণতন্ত্র-সম্মত নহে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচারে, অধিকারের নীতি বিচারে, শাসনের সীমা বিচারে সর্বতো ভাবে ব্যর্থ ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই স্বামীর মৃত্যুর কারণ। একই মামলায় অন্য যাঁহারা বন্দি হইয়াছেন, কবি ভারাভারা রাও বাদে তাঁহাদের কেহই জামিন পান নাই। এলগার পরিষদের মতো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা লইয়া রাষ্ট্রীয় তদন্তকারীদের এমন অতিকঠোরতা প্রমাণ করে, নরেন্দ্র মোদীর ভারতে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ বিষয়টি আসলে সরকারের অপছন্দের লেখক-সাংবাদিক-সমাজকর্মীদের শিকার করিবার অজুহাত। আইন-শাসন-বিচার, গণতন্ত্রের সকল স্তম্ভই সে সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্পূর্ণত নারাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy