কী ছিল ব্রিটেন, আর কী হইয়াছে, তাহা দেখিয়া খেদোক্তি করিয়াছেন কেমব্রিজের অধ্যাপক পার্থ দাশগুপ্ত। ১৯৭০-এর দশকে ছাত্রজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন করিবার ক্ষেত্রটির কোনও গণ্ডি ছিল না। আর এখন কোনও গবেষকের অপ্রিয় মতামত কদাচ প্রকাশিত হইয়া গেলে তাঁহার জীবনের দায়িত্বটি বিধাতাপুরুষের হস্তে সমর্পণ করিয়া দিতে হয়। সম্প্রতি বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইশত শিক্ষাসাধক শিক্ষাপ্রাঙ্গণে যে ঘৃণার সম্মুখীন হইবার অভিজ্ঞতা শুনাইয়াছেন— তাহাতে খুনের হুমকি, শারীরিক নিগ্রহ, গবেষণা বন্ধ হইয়া যাওয়া, কী নাই! বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকেরাও যথাযোগ্য সাহস দেখাইয়া এই অনাচার বন্ধ করিতে পারিতেছেন না। বিরুদ্ধমত শুনিতে ছাত্র-গবেষক সমাজের প্রবল অনীহা এবং সকলকে ঠাঁই দিতে কর্তৃপক্ষের অযোগ্যতা উচ্চশিক্ষা পরিসরের বলিষ্ঠতা খর্ব করিতেছে। যে সমালোচনায় কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকে বিদ্ধ করে বিদ্বজ্জন সমাজ, সেই অসুখে বিষাইয়া গিয়াছে তাঁহাদের লেখাপড়ার স্থানটিই। আপন প্রাঙ্গণতলে মুক্তমনে বলিবার ও লিখিবার অধিকার তাঁহারা হারাইতেছেন। স্বজনের ব্যভিচারে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ বিষয়ে শিক্ষাদান করিলেও একটি মূল পাঠ শিক্ষণীয়— প্রশ্ন করিবার অধিকার। যে বিষয়ই হউক, যাহা ঘটিতেছে তাহা যাচাই করিতে না পারিলে, নূতন ভাবনা জন্ম লয় না। চিরাচরিতকে ভাঙিয়া দেখাই সেই কারণে সর্বাধিক জরুরি। আর, নিরন্তর আলাপ-আলোচনার অবকাশটি বাঁচাইয়া রাখিতে না পারিলে পুরাতনকে প্রশ্ন করিবার সেই স্পর্ধা তৈরি হইবে না। গবেষণার আবশ্যিক শর্তরূপে খণ্ডনযোগ্যতাকে চিহ্নিত করিতেন দার্শনিক কার্ল পপার। উহাই শিক্ষাজীবনের প্রাণভ্রমর। স্মর্তব্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের আদি সংজ্ঞাতেও গ্রথিত শিক্ষার স্বাধীনতার প্রশ্নটি। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউনিভার্সিটি অব বোলোনি-র শিক্ষাসনদে বলা হইয়াছিল যে, শিক্ষার স্বার্থেই গবেষণার গতিপথ কদাপি রোধ করা চলে না। অধুনা যাঁহারা ‘প্রগতিবিরোধী’ দাবি করিয়া বিশেষ গবেষণার পথ আগলাইয়া দাঁড়াইতেছেন, তাঁহারা শিক্ষার স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করিতেছেন। তাঁহারাই শিক্ষাগ্রহণের দ্বারা অগ্রগতির তথা সামাজিক প্রগতির পরিপন্থী।
ছাত্র-গবেষক সমাজের এই রূপ আচরণে উদ্বেগের কারণ আছে। এমন পরমত অসহিষ্ণু মানসিকতাকে শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নাক গলাইবার চিত্রেরই ক্ষুদ্র প্রতিফলন বলিয়া মনে হয়। বিগত কয়েক বৎসরে ভারতের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-গবেষক দলের আপত্তিতে আলোচনা সভা রদ হইয়াছে, বাতিল হইয়াছে অধ্যাপকের আমন্ত্রণ। সেই প্রসঙ্গে বিশেষ কথাও হয় নাই, সমসত্ত্ব ভাবনার মোহাবরণে ‘পশ্চাৎমুখী বিষয়সমূহ’ ঠেকাইয়া রাখিতে ঐকমত্য গড়িয়া উঠিয়াছে। কিন্তু, সঙ্কটের জন্মও সেই স্থলেই। যে কোনও গোঁড়ামি শিক্ষার আগাইবার পথে বাধাস্বরূপ। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ ছাত্র সংগঠনের দাবিতে অনুষ্ঠান স্থগিত হইলে তাহা নিন্দার্হ, রাষ্ট্রশক্তির মদতের কারণে সেই অন্যায়ের অভিঘাতটিও পৃথক; কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা এমন অনমনীয় মনোভাব পোষণ করিলে তাহাও নিন্দনীয়। যদি মুক্তচিন্তার পরিবেশ বজায় রাখিবার দায়িত্ব পালিত না হয়, যদি নির্ভয়ে প্রশ্ন করিবার সাহস না পান গবেষকেরা, তবে পুরাতনকে স্পর্ধা দেখাইবার পরিসরটিও মরীচিকা হইয়া উঠিবে। বিলীন হইবে প্রকৃত শিক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy