গত মাসে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতবর্ষ পূর্ণ হল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯২২ সালে, তিনটি কলেজ নিয়ে। এই বিদ্যায়তনের পরিমণ্ডলে এখন আশিটি কলেজ। প্রতি বছর পড়তে আসেন প্রায় সত্তর হাজার ছাত্রছাত্রী। নিছক সংখ্যার মাপকাঠিতে নয়, পঠনপাঠন ও গবেষণার বিষয়বৈচিত্র এবং গুণগত উৎকর্ষের বিচারের সঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় তার সর্বভারতীয় চরিত্রের কথা। রাজধানীর অন্যতম প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সুবাদে এবং শিক্ষা ও গবেষণার খ্যাতির কারণে এই প্রতিষ্ঠানে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু শিক্ষার্থীর সমাগম কার্যত শুরু থেকেই, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার আওতায় থাকা বেশ কয়েকটি কলেজ স্বচ্ছন্দে নিজেদের ভারততীর্থ হিসাবে দাবি করতে পারে। বিদ্যাচর্চার নির্দিষ্ট পরিসরে নয়, সাংস্কৃতিক মিলনের ক্ষেত্র হিসাবেই সেই দাবি সঙ্গত। বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন সংস্কৃতির, বিভিন্ন মানসিকতার এবং বিভিন্ন মতামতের ছাত্রছাত্রী, গবেষক ও শিক্ষকদের নিরন্তর কথোপকথন ও আদানপ্রদানের ধারা, যার মধ্য দিয়ে উদার এবং বহুমাত্রিক ভারতের ধারণাটি কেবল সমৃদ্ধ হয় না, ক্রমাগত বিবর্তিত হয়ে চলে। সমস্যা এবং ঘাটতির পরিমাণও কম নয়, মাঝে মাঝেই সেই কারণে এই প্রতিষ্ঠান ‘খবর’ হয়। বিশেষত, সাম্প্রতিক কালে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় আসীন শাসকদের সঙ্কীর্ণ ও পশ্চাদ্গামী চিন্তাভাবনার কুপ্রভাব এই বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছে, মহাশ্বেতা দেবী-সহ একাধিক বিশিষ্ট স্বাধীনচেতা লেখকের রচনা শাসকের মনঃপূত না হওয়ার অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি থেকে বাতিল হওয়ার মতো দুর্ভাগ্যজনক এবং উদ্বেগজনক ঘটনাও বাকি থাকেনি। তবু প্রতিষ্ঠানটিকে শতবর্ষের অভিবাদন।
সেই অভিবাদনে যদি ঈষৎ বেদনা মিশে থাকে, সেটা নিশ্চয় ক্ষমণীয়! এই শহরের তথা রাজ্যের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টি বয়সে দিল্লির শতবর্ষীয় প্রতিষ্ঠানটির থেকে ছয় দশকেরও বেশি প্রবীণ। নিছক বয়সে নয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও মর্যাদা এক কালে বিশ্ববন্দিত ছিল বললে অত্যুক্তি হয় না। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হওয়ার পরে এক দশক যেতে না যেতেই সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা— দুই ঘটনার মধ্যে প্রত্যক্ষ না হোক, পরোক্ষ ভাবে কার্যকারণসূত্র ছিল। কিন্তু তার পরেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব কিছুমাত্র কমেনি, বরং পরবর্তী কয়েক দশক তার ইতিহাসে নানা দিক থেকে উজ্জ্বল। সেই সম্মান স্বাধীনতার পরেও বেশ কিছু কাল অবধি বজায় ছিল। কিন্তু আজ— সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি। বস্তুত, আজ নয়, অনেক দিন যাবৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান ক্রমশ নেমেছে, তার অনিবার্য প্রভাব পড়েছে বিশ্বের জ্ঞানচর্চার পরিসরে প্রতিষ্ঠানটির প্রসিদ্ধিতে। বিপুলসংখ্যক কলেজের নিয়ামক হিসাবে আজও তার কলেবর সমীহ আদায় করে, কিন্তু সেটা পরিমাণের কারণে, উৎকর্ষের কারণে নয়। গুরুভার আর গুরুত্ব এক নয়। পঠনপাঠন এবং গবেষণার মাপকাঠিতে এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার আওতায় থাকা কলেজগুলি এখন বহুলাংশেই মধ্যমেধায় আকীর্ণ। বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে এখনও কিছু কিছু ভাল কাজ নিশ্চয়ই হয়, যেমন হয় অন্য কোনও কোনও ব্যতিক্রমী এলাকাতেও, কিন্তু তা মোটের উপর ব্যতিক্রম। সর্বভারতীয় ‘উৎকর্ষ তালিকা’য় এখনও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান আপাতদৃষ্টিতে সম্মানজনক, কিন্তু তার পিছনে প্রধান অবদান আয়তনের, প্রকৃত উৎকর্ষের নয়।
এই পরিণতির কারণ একটি নয়, অনেক। কিন্তু যদি কোনও একটি কারণকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে হয়, তবে তার নাম কূপমণ্ডূকতা। যত দিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টি প্রসারিত ছিল, যত দিন বিশ্বের বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তার পঠনপাঠনের কাঠামো ও গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হত, তত দিন উৎকর্ষও বজায় ছিল। কিন্তু গত শতাব্দীর সত্তর-আশির দশক থেকে, বামফ্রন্ট জমানা কায়েম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই উৎকর্ষের বদলে দলীয় আনুগত্যই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে, এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানগুলিতে তার প্রচণ্ড প্রভাব পড়ে তাদের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ই সম্ভবত এক নম্বর। সেই ধারা আজও বহমান, বস্তুত তার রূপটি আজ আরও বেশি প্রকট, স্থূল, নিরাবরণ। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে কলকাতার অগ্রজ প্রতিষ্ঠানটি আজ নিশ্চয়ই তাকে শুভেচ্ছা জানাতে পারে, তবে সেই শুভেচ্ছার আড়ালে দীর্ঘশ্বাসটিকে লুকিয়ে রাখা কঠিন।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy