নতুন সংসদ ভবন তৈরি হবে, তার উপরে নতুন অশোকস্তম্ভ বসবে, সেই স্তম্ভে বিরাজ করবে নতুন সিংহেরা। এতে আর গোল হবে কি? কিন্তু গোল বেধেছে সিংহের চেহারা আর হাবভাব নিয়ে। পুরনো স্তম্ভে যাদের দেখা যায় তারা কেমন শান্তশিষ্ট, সৌম্যদর্শন, দেখলে ভক্তি হয়। নতুনদের যে রূপ প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্যে উন্মোচিত হয়েছে, তাদের দেখে ভক্তি হয় কি না সে কথা তাঁর ভক্তরাই বলতে পারবেন, কিন্তু পশুরাজের স্ফীত বক্ষদেশ, সামনের দুই পায়ে প্রকট পেশির বাহার এবং মুখগহ্বরে শোভিত ধারালো দাঁতগুলি দেখে ছাপোষা মানুষ রীতিমতো ভয় পাবেন, আর শিশুরা এক বার এ-জিনিস দেখে ফেলার পরে রাতবিরেতে ভয়ে কেঁদে উঠবে। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ভক্তবৃন্দ সমস্বরে ‘ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না’ বলে আশ্বাস দিলেও সেই সম্ভাবনা দূর হবে বলে ভরসা হয় না। এই অপরূপ সিংহমূর্তির উদ্ভাবক ও পৃষ্ঠপোষকরা অবশ্য অভয় দিয়েছেন— ওরা অনেক উপরে থাকবে, নীচ থেকে তাদের উত্তাল পেশি এবং করাল দংষ্ট্রা আমজনতার চোখে ভাল করে ধরা পড়বে না। হবেও বা। তবে কিনা, দিনকাল যা পড়েছে, পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশন বা মোবাইলের পর্দায় উৎকট মূর্তিগুলির লক্ষ লক্ষ ‘ক্লোজ় আপ’-এর অবিরত প্রচারতরঙ্গ রুধিবে কে? তাই, মহামান্য নরেন্দ্র মোদীর কাছে মার্জনা ভিক্ষা করে সবিনয় নিবেদন জানিয়ে বলতেই হয়: কিছু ভয় রহিয়া গেল।
সে-কথা শুনে অবশ্য মান্যবরেরা কিছুমাত্র বিচলিত হবেন বলে মনে হয় না, বরং মনে মনে বলবেন, সংসদ ভবনের নবকলেবর এতদ্দ্বারা ষোলো আনা সার্থক হতে চলেছে। ভয় দেখিয়ে শাসন করার যে প্রকল্প তাঁরা প্রায় এক দশক ধরে একাগ্র নিষ্ঠায় রূপায়ণ করে চলেছেন, রাষ্ট্রের পরম প্রতীকেও অতঃপর সেটি নিরাবরণ হয়ে উঠবে, ভারতীয় গণতন্ত্রের নতুন ইমারতের মাথার উপরে বিরাজমান হবে মূর্তিমান ভয়, কোনও সত্যই আর আড়ালে থাকবে না। রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতার, তথা স্বচ্ছ ভারতের, এর চেয়ে ভাল পরিচয় আর কী হতে পারে? দূর থেকে দেখলে মূর্তিগুলিকে হিংস্র মনে হবে না— এই অভয়বাণীর গূঢ় অর্থটিও কি প্রণিধানযোগ্য নয়? যে রাষ্ট্রযন্ত্র ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং গলা ফুলিয়ে চোখ পাকিয়ে ‘আগামী পঞ্চাশ বছর’ প্রতিষ্ঠিত থাকবার বার্তা দিচ্ছে, তাকে দূর থেকে দেখলে গণতন্ত্র বলে মনে হতে পারে, কিন্তু কাছে গিয়ে ঠাহর করলে ছবিটা পাল্টে যায়, তার চোখে চোখ রেখে সামান্যতম প্রশ্ন তুললেও মুখের পেশিগুলি নিমেষে কুলিশকঠিন, দৃষ্টিতে নেমে আসে ভয়াল শীতলতা। ভয় রাষ্ট্রের পুরনো অস্ত্র; ক্ষমতা কায়েম রাখতে ভয় দেখানোর রীতি বর্জন করে চলতে পেরেছে এমন রাষ্ট্র আজও জন্মায়নি, স্বাধীন ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়; কিন্তু গণতান্ত্রিক ভারতের বর্তমান জমানাটি যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁদের বৈশিষ্ট্য এখানেই যে সেই অস্ত্রের নিরন্তর এবং যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে এখন আর রাখঢাক নেই। সিংহমশাই এখন দৃশ্যত ভয়ানক। তার মুখচোখ এবং অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে পড়ে যায় দ্য লায়ন কিং ছবির রাজভ্রাতা ‘স্কার’-এর কথা, ভাই মুফাসাকে ধ্বংস করে যে রাজা হয়েছিল।
মুফাসার সন্তান শেষ অবধি রাজ্যপাট ফিরে পেয়েছিল, আরণ্যক প্রজারা স্বস্তি ফিরে পেয়েছিল রাজা সিম্বার দক্ষিণমূর্তি দেখে। সিনেমায় যা হয়, বাস্তবে তা হবে কি? গণতন্ত্রের ইতিহাস জানিয়ে দেয়— এবং ভরসা দেয়— এই প্রশ্নের উত্তর নির্ধারণ করবেন দেশের নাগরিকরাই। সেই উত্তর ইতিবাচক হবে কি না, ভরসা সার্থক হবে কি না, সে-কথা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। বস্তুত, এই মুহূর্তে ভারত নামক দেশটির হাল দেখে দুশ্চিন্তা হয়, এই নতুন সিংহবাহিনীই বুঝি তার উপযুক্ত দোসর, তাদের এই স্ফীতবক্ষ করালবদন প্রতিমাগুলিই দেশবাসীর একটা বড় অংশের পছন্দসই, কারণ তাঁরা শাসকদের ভয় পেতেই চান। ভয়ই যদি রাজভক্তির প্রধান উপকরণ হয়ে ওঠে, তবে ভয়ের শাসন জারি রাখা সহজ হয় বটে। মাকিয়াভেলি কত কাল আগেই রাজপুত্রের কানে কানে বলে গিয়েছেন: প্রীতি অপেক্ষা ভীতি বেশি নিরাপদ, এটা যেন ভুলো না বাপু। অতএব, ভয় হয়, এখন থেকে হয়তো বাতাসে মাঝে মাঝে ভেসে আসবে ভারতীয় গণতন্ত্রের স্মৃতিমেদুর বেদনাবিধুর আর্তি: আর কি কখনও কবে অশোকস্তম্ভে সৌম্য শান্ত ভদ্র সিংহেরা ফিরে আসবে? এবং তা শুনে নতুন সংসদ ভবনের মাথায় বসে নয়া মূর্তিরা উত্তর দেবে: যে ধাতু থেকে হিংসা-র উৎপত্তি, সিংহ-ও সেই একই ধাতুতে গড়া, এই সামান্য ব্যাকরণটুকুও জানো না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy