ফাইল চিত্র।
রাজ্যপালকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য করে দিলে কী হতে পারে, দেশের বিভিন্ন রাজ্যেই তা বারংবার দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গ তো ব্যতিক্রম নয়ই, বরং এই রাজ্যের বর্তমান রাজ্যপাল যত অঘটন ঘটিয়েছেন তার দীর্ঘ তালিকার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে আচার্য হিসাবে তাঁর অতুল কীর্তিগুলি। সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের সরকার তথা শাসক দল যদি রাজ্যপালের আচার্য-রূপটি বিলোপ করতে তৎপর হয়ে থাকে, সেই উদ্যোগকে অযৌক্তিক বলা চলে না। অবশ্য, শিক্ষা নিয়ে এত রকমের সমস্যা থাকতে হঠাৎ এখনই কেন এই বিষয়ে শাসকদের ব্যস্ত হয়ে উঠতে হল, কিংবা ওই সব সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর মতলবেই তাঁরা সময় বুঝে এই আচার্য-বদলের প্রকল্পটি বাজারে ছেড়েছেন কি না, নাগরিকের মনে সে সব প্রশ্ন জাগতেই পারে। শিক্ষার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান চালকদের চেতনা ও চিন্তাভাবনার যা বহর, তাতে অবশ্য তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর এই নজির দেখে কেউ অবাক হবেন না। শাসকের গুণগ্রাহীরা হয়তো বা বলবেন, একটা ভুল রীতির সংশোধনের পক্ষে যে কোনও সময়ই প্রশস্ত।
তা, সংশোধনের তো নানা উপায় ছিল। সবচেয়ে ভাল হত আচার্য পদটিকেই তুলে দিলে, অন্তত একটি অলঙ্কারের বোঝা লাঘব হত। তবে কিনা, বাঙালি অলঙ্কার ভালবাসে, তার শাসকরাও তথৈবচ, সুতরাং আচার্য ছিলেন, আছেন, থাকবেন। সে ক্ষেত্রে এই পদটিতে যাতে এর পর থেকে কোনও যোগ্য এবং স্বীকৃত শিক্ষাবিদ অধিষ্ঠিত হতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা যেত সহজেই। তাঁকে নির্বাচনের দায়িত্বটি দেওয়া যেত একটি যথোপযুক্ত বিদ্বৎমণ্ডলীর হাতে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সে-সব কিছুই হচ্ছে না। হওয়ার কোনও প্রত্যাশাও ছিল না। রাজ্যপালকে আচার্যের পদ থেকে সরানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকার সেই পদে যাঁকে বসানোর বন্দোবস্ত করছে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী সরকারের প্রধান, সুতরাং বলা যেতেই পারে যে, মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে আচার্যের চেয়ারে বসানোর বন্দোবস্ত করছেন। ‘অবাক কাণ্ড’ বললে যথেষ্ট হয় না, আজব দেশে উপনীত অ্যালিসের ভাষায় বলা যেতে পারে: কিউরিয়সার অ্যান্ড কিউরিয়সার!
মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর পারিষদরা ক্ষুণ্ণ ও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলতে পারেন, তাঁর শিক্ষা-সংস্কৃতির মান নিয়ে কটাক্ষ করা অশোভন, অন্যায়। এই অভিযোগের উত্তরে স্পষ্ট ভাষায় বলে নেওয়া দরকার যে, প্রশ্নটা এখানে ব্যক্তিগত নয়, নীতিগত। আচার্য বা অনুরূপ পদের মর্যাদা যদি অক্ষুণ্ণ রাখতে হয়, তবে রাজনীতিক তথা প্রশাসকদের তা থেকে দূরে থাকা জরুরি, তা না হলেই শিক্ষার পরিসরে ক্ষমতার ছায়া এসে পড়ে। বাস্তবিক ক্ষমতার ছায়া সরিয়ে কাজ করা এ ক্ষেত্রে দুষ্কর। তবে এ কথা ঠিক যে, সব শাসকই সেই ক্ষমতার সমান ব্যবহার বা অপব্যবহার করেন, এমন বলা যাবে না। কিন্তু উচ্চশিক্ষার সুস্থতা ও মানরক্ষার স্বার্থে, ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রটা যাতে তৈরিই না হয়, সেটাই নিশ্চিত করা দরকার। এই কারণেই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শীর্ষপদে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির অবস্থানও একই রকম অনভিপ্রেত, সেই প্রধানমন্ত্রীর নাম পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু হলেও অবাঞ্ছিত। বস্তুত, স্বাধীন ভারতের জন্ম থেকেই যদি এই দূরত্বের নীতিকে কঠোর ভাবে অনুসরণ করা হত, আজ পরিস্থিতি হয়তো এখানে পৌঁছত না। তবে, মানতেই হবে, আইন বা রীতি শেষ অবধি ক্ষমতাবানদের সদিচ্ছা এবং সুবিবেচনার উপরেই বহুলাংশে নির্ভর করে। দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, দেশে এবং রাজ্যে সেই বস্তুগুলির অভাব উত্তরোত্তর বাড়ছে। ফলে, রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের আসনে মুখ্যমন্ত্রীর অভিষেকেই তাঁর সরকার নিরস্ত হচ্ছে না, অন্য নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাথায় শিক্ষামন্ত্রীকে বসানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পূর্ণগ্রাস না হওয়া অবধি শান্তি নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy