তিন বৎসর পূর্বে তুরস্কের সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির অগ্রণী কর্মী এচে তেমেলকুরান হাউ টু লুজ় আ কান্ট্রি নামক একটি বই লিখিয়াছিলেন। প্রধানত স্বদেশের তমসাবৃত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখিত সেই গ্রন্থে তিনি দেখাইয়াছিলেন— একটি গণতান্ত্রিক দেশ কী ভাবে, কেমন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া ক্রমশ স্বৈরশাসনের কবলে চলিয়া যাইতে পারে। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব জুড়িয়া, বিশেষত পশ্চিম দুনিয়ায়, বিপুল খ্যাতি অর্জন করে। তেমেলকুরান নানা দেশে বক্তৃতা দিবার আমন্ত্রণ পান। সেই সকল সভায় অনেকেই তাঁহাকে প্রশ্ন করিতেন: রেচেপ তাইপ এর্দোয়ান শাসিত তুরস্ক কী ভাবে স্বৈরতন্ত্রের কবল হইতে নিজেকে উদ্ধার করিতে পারে, তাহার জন্য সেই দেশের নাগরিকদের কী করণীয়, এই বিষয়ে তাঁহার মত কী। ইউরোপ আমেরিকার শ্রোতাদের এই প্রশ্নের উত্তরে প্রখর বুদ্ধিমতী তেমেলকুরান অনেক সময়েই বলিতেন: তুরস্কের সঙ্কট অবশ্যই গভীর, কিন্তু আপনারাও নিশ্চিন্ত থাকিবেন না, সতর্ক হউন, সংগঠিত ও সক্রিয় হউন, নচেৎ আপনাদের গণতন্ত্রও স্বৈরতন্ত্রের পথে পিছলাইয়া যাইতে পারে, তাহার বহু সঙ্কেত চারিদিকে ছড়ানো রহিয়াছে।
তিন বৎসর পরে পশ্চিম দুনিয়ায় গণতন্ত্রের বিপদসঙ্কেত কি কাটিয়াছে? আশাবাদীরা এই প্রশ্নের উত্তরে সর্বাগ্রে যে দেশটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিবেন তাহার নাম অবশ্যই আমেরিকা। তাঁহারা বলিবেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই দেশের ক্ষমতায় ফিরিতে পারেন নাই, ইহা কি সুলক্ষণ নহে? তাঁহারা জার্মানির কথাও বলিবেন। তীব্র নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দীর্ঘ নির্বাচন-উত্তর টানাপড়েনের পরে পশ্চিম ইউরোপের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেশটিতে যাঁহারা সরকার গড়িয়াছেন, তাঁহাদের বামপন্থী মানসিকতা কতটা খাঁটি তাহা লইয়া ‘খাঁটি বামপন্থা’র ধ্বজাধারীরা অনন্ত তর্ক চালাইতে পারেন, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতি তাঁহাদের দায়বদ্ধতা লইয়া কোনও প্রশ্ন নাই। ইংল্যান্ডে বরিস জনসন বা ফ্রান্সে ইমানুয়েল মাকরঁ প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতি আন্তরিক ভাবে কতটা শ্রদ্ধাশীল তাহা লইয়াও প্রশ্ন থাকিতে পারে, কিন্তু তাঁহাদের রাজনীতিকে স্বৈরতন্ত্রের অনুশীলন বলিলে অবিচার হইবে। হাঙ্গেরি বা পোল্যান্ডের মতো দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের আধিপত্য নিশ্চয়ই অপ্রতিহত, কিন্তু তাহা পুরাতন সমস্যা। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে, পশ্চিমি গণতন্ত্রের বিপদ বাড়ে নাই, বরং অংশত কমিয়াছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিরোধে সক্রিয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়চ-এর সদ্য-প্রকাশিত রিপোর্টও তেমন আশার বাণী শুনাইয়াছে।
কিন্তু আশার বিপরীতে আশঙ্কা কম নহে, সুলক্ষণের পাশাপাশি দুর্লক্ষণও বিস্তর। যেমন, আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হইলেও আদৌ হার মানেন নাই, বরং তিনি ও তাঁহার অনুগামী তথা অনুচররা প্রবল বিক্রমে তাঁহাদের উগ্র রাজনীতির অভিযান চালাইতেছেন এবং রিপাবলিকান পার্টিতে নূতন করিয়া সেই রাজনীতির দাপট উত্তরোত্তর প্রবল হইতেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন মুখে সেই অভিযানকে প্রতিহত করিবার কথা বলিতেছেন বটে, কিন্তু তাঁহার দৌড় কত দূর সেই বিষয়ে বড় রকমের সংশয় আছে, ডেমোক্র্যাট শিবিরের অন্তর্নিহিত বিভাজন ও দুর্বলতা যে সংশয়কে ঘনীভূত করে। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ‘ছিনতাই’ হইবার আশঙ্কা রহিয়াছে। ২০২০-র জানুয়ারিতে আইনসভার ভবনে ‘অভ্যুত্থান’ ব্যর্থ হইয়াছিল, ট্রাম্প শিবিরের পরবর্তী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইবে, তাহার কিছুমাত্র নিশ্চয়তা নাই। অন্য দিকে, ইউরোপে উগ্র জাতিবৈর এবং বর্ণবিদ্বেষের প্রবক্তারা আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা দুর্বল হইলেও তাঁহাদের তৎপরতা নূতন উদ্বেগের কারণ হইয়াছে। হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন স্বৈরনায়কদের নেতৃত্বে ও উদ্যোগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের চরম দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি মহাদেশের স্তরে সংগঠন গড়িতেছে, তাহাদের নায়কনায়িকারা ঘন ঘন বৈঠকে বসিতেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এর যৌথ পরিবারের সুযোগ কাজে লাগাইয়া দানা বাঁধিতেছে স্বৈরবাদীদের যূথশক্তি। দৃশ্যত, ইহা ‘ওয়র অব পোজ়িশন’-এর পর্ব। সুতরাং, নিশ্চিন্ত বোধ করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই। এচে তেমেলকুরানের সতর্কবাণী সত্য প্রমাণিত হইবার সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে আরও বাড়িতে পারে। কেবল পশ্চিম দুনিয়ায় নহে, বিশ্ব জুড়িয়াই। প্রসঙ্গত, হিউম্যান রাইটস ওয়চ-এর পূর্বোক্ত রিপোর্টটিতে যে সব দেশের বিপন্ন গণতন্ত্র সম্পর্কে উদ্বেগ জানানো হইয়াছে, ভারত তাহাদের অন্যতম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy