বৎসরকাল পার করিল হংকং শহরের জাতীয় নিরাপত্তা আইন। বলবৎ হওয়া ইস্তক তাহা লইয়া বিতর্কের শেষ নাই। যে চার প্রকার অপরাধ— সন্ত্রাসবাদ, দমনপীড়ন, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও বিদেশি শক্তির সহিত ঘনিষ্ঠতা ঠেকাইতে এই আইন, তাহার কল্পনাটি শাসকের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বলিয়া অভিযুক্ত। বিগত সপ্তাহে তাহার বলে প্রথম ব্যক্তির দোষী সাব্যস্ত হইবার ঘটনা সেই সংশয়ের ভিত দৃঢ়তর করিয়াছে। বাইকে চড়িয়া হংকং-এর ‘মুক্তি’র দাবি প্রদর্শনের অর্থ হইয়াছে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ও ‘সন্ত্রাসবাদ’, সাজা হইয়াছে নয় বৎসরের কারাবাস। ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতিতে পরিচালিত স্বশাসিত নগরীটি চিনের মূল ভূখণ্ডের বজ্রকঠিন শাসনের ভিতর এযাবৎ কাল ছিল এক মরূদ্যান— স্বাধীন মতপ্রকাশের পীঠস্থান। যে কোনও মুক্ত সমাজের ন্যায় হংকং-এও প্রতিষ্ঠান-বিরোধী প্রতিবাদ ছিল স্বাভাবিক কথা। কমিউনিস্ট স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলিতে মুক্তির এই গলিটিই ব্যবহার করিতেন ‘ডিসিডেন্ট’ বা শাসকের প্রতি বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিবর্গ। তাহা যে এমন সমূলে পাল্টাইয়াছে, সম্ভবত অনুধাবন করেন নাই গণতন্ত্রপন্থীরা।
এই প্রসঙ্গে হংকং-এর ব্যবসায়ী চান তাৎ চিং-এর মন্তব্যটি তাৎপর্যবাহী। তিয়েনআনমেন স্কোয়্যার গণহত্যার পর হইতে ছাত্র, গবেষক, শিক্ষকদের চিন ত্যাগের ব্যাপারে সহায়তা করিতেন তিনি। কিন্তু নয়া আইন প্রবর্তনের পর মূক হইয়াছেন চান। তাঁহার বক্রোক্তি: যে শাসক বলপ্রয়োগ না করিয়াও মুক্তমনা সমাজকে বশীভূত করিতে পারে, তাহার শ্রদ্ধা প্রাপ্য। অতএব অবশিষ্ট সমাজকর্মীগণও দ্রুত বুঝিয়া লউন যে, বেজিং কোনও কাগুজে বাঘ নহে, তাহার শ্বদন্ত প্রয়োজনের অধিক সক্রিয়। নয় বৎসর কারাবাসের সাজা ঘোষণার প্রথম গুরুত্বটি এইখানেই। তাহা বুঝাইয়া দিতেছে, হংকং এক সম্পূর্ণ নূতন জমানায় প্রবেশ করিয়াছে, পূর্বেকার অবাধ সমাজ হইতে যাহার ফারাকটি মূলগত। এক্ষণে বিরুদ্ধমত পোষণ প্রতিবাদীদের পক্ষে ছোটখাটো বিপদ বা অস্বস্তির অধিক কিছু ঘটাইবে— আস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেই সামাজিক ভাবে অপরাধী, এমনকি অনস্তিত্ব করিয়া দিবে। একমাত্র রাষ্ট্রীয় মতেরই বিরাজ করিবার অধিকার আছে। অপর সকলই, আইন অনুসারে, জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক।
ঘটনার দ্বিতীয় গুরুত্ব পরিবর্তনটির চরিত্রে। যে নগর আক্ষরিক অর্থেই এক ‘মেট্রোপলিস’ ছিল, যেখানে বহু জাতি-ধর্মের মেলামেশা এবং বহু ভাষা-সংস্কৃতির সমাবেশ ঘটিত, যাহার ফলে চিন্তার শতফুল বিকশিত হইত, সেইখানে মার্টিন লুথার কিং এবং নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনী নিষিদ্ধ হইবার পরে প্রতিবাদটুকুও ধ্বনিত হইল না। বরং, স্বতঃপ্রণোদিত নজরদার নাগরিক গজাইয়া উঠিল, যাঁহারা প্রতিবেশীর গৃহে বিদ্যালয়ের নূতন পাঠ্যক্রমের সমালোচনা শুনিলে তাঁহাকে ‘রাজদ্রোহ’-এর অপরাধে পুলিশের হাতে তুলিয়া দিতেছেন। বৎসরকালের ভিতরেই এই বদল ঘটিয়াছে, তাহাও অত্যন্ত নিঃশব্দে। বিশ্ব-রাজনীতির প্রেক্ষিতে যদিও ছবিটি বিস্মিত করিবে না। ক্ষমতাবান ও দলবলের হিংসাত্মক অতি সক্রিয়তা, এবং তাহার পাল্টা অপার নীরবতাই স্বৈরাচারী শাসকের অভিজ্ঞান। সকলেই জানেন, যাবতীয় অস্বস্তির বিলয় ঘটাইতেই অভ্যস্ত চিনের পার্টি-রাষ্ট্র। হংকং-এও এই বার সেই ‘নবযুগ’ নামিয়া আসিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy