Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Government project

শ্রীবৃদ্ধির ফাঁদ

স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়ন যে অতি জরুরি কাজ, এবং তার জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ প্রয়োজন, এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৩ ০৬:৩৭
Share: Save:

এ বার স্কুলের নামেও রাখতে হবে প্রকল্পের নাম, এমনই শর্ত তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ‘পিএম শ্রী’ (প্রধানমন্ত্রী স্কুলস ফর রাইজ়িং ইন্ডিয়া— অনুমান করা চলে, সংক্ষেপে যাতে ‘শ্রী’ লেখা সম্ভব হয়, তার জন্য বিস্তর কষ্টকল্পনার মাধ্যমে প্রাপ্ত একটি নাম) প্রকল্পটি দেশের নানা রাজ্যে রাজ্য সরকারের অধীন কিছু স্কুলকে বিশেষ আর্থিক অনুদান দিতে চায়। তা দিয়ে তৈরি হবে সৌর প্যানেল, যাতে স্কুল ভবনটি ‘গ্রিন বিল্ডিং’ হয়ে উঠতে পারে। এলইডি আলো, পুষ্টি বাগান প্রভৃতি তৈরি হবে। বর্জ্যের যথাযথ নিকাশি, জল সংরক্ষণ প্রভৃতির দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সুস্থায়ী জীবনযাত্রার ধারণা জন্মানোই হল উদ্দেশ্য। পঠনপাঠনের উন্নতির জন্য এই প্রকল্পে কী করা হবে, তা অবশ্য খুব স্পষ্ট নয়। সেখানে কেবল এটুকুই বলা হয়েছে যে, ছাত্রছাত্রীরা বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, অর্থাৎ হাতে-কলমে নানা কাজের মাধ্যমে শিখবে। প্রতি শ্রেণির উপযোগী শিক্ষা যাতে ছাত্রছাত্রীরা আয়ত্ত করে, তার উপর জোর দেওয়া হবে, এবং ধারণা তৈরির উপর বেশি জোর দেওয়া হবে। প্রকল্পের নামে শ্রী-যুক্ত প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ থাকলেও এ সবের জন্য যা কিছু বাড়তি খরচ হবে, তার সবই যে কেন্দ্র খরচ করবে এমন নয়। প্রকল্পের চল্লিশ শতাংশ খরচ বহন করতে হবে রাজ্যগুলিকেও। প্রত্যাশা মতোই, বিরোধী রাজ্যগুলি এই প্রকল্পে যোগ দিতে রাজি হয়নি। তামিলনাড়ু, ওড়িশা, বিহার, দিল্লি, কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গ এই প্রকল্পে যোগদানের প্রস্তাবে সায় দেয়নি। কেরল এবং ওড়িশা জানিয়েছে, তারা তাদের স্কুলগুলির পরিকাঠামো ইতিমধ্যেই উন্নত করার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কর্নাটক এবং তামিলনাড়ু কেন্দ্রের নয়া শিক্ষানীতিতে সায় দেয়নি, ফলে স্কুলশিক্ষার প্রকল্পও গ্রহণ করতে রাজি নয়।

স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়ন যে অতি জরুরি কাজ, এবং তার জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ প্রয়োজন, এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকারের একটি বৈশিষ্ট্য এই, অতি জরুরি কাজের প্রস্তাব তারা এমন প্রকল্পের মোড়কে পেশ করে যে, রাজ্যগুলির কাছে তা নিতান্ত আপত্তিকর ঠেকে। বেশ কিছু প্রকল্পে রাজ্য সরকার চল্লিশ শতাংশ অর্থ দেওয়া সত্ত্বেও সেগুলিতে একতরফা ভাবে কেন্দ্রের নির্ধারিত নাম লাগানোর উপর জোর দেয় মোদী সরকার। এতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর হানি হয়, তাই কৃষি থেকে স্বাস্থ্য পর্যন্ত বহু কেন্দ্রীয় প্রকল্প রাজ্যগুলি হয় প্রত্যাখ্যান করেছে, অথবা দেরিতে গ্রহণ করেছে। বিশেষত শিক্ষা যৌথ তালিকায় থাকলেও, স্কুলশিক্ষা প্রধানত রাজ্য সরকারেরই দায়িত্ব। কিছু অর্থের বিনিময়ে স্কুলগুলিকে কেন্দ্রের প্রকল্পাধীন বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা অনর্থক হস্তক্ষেপ মনে হতে বাধ্য। একটি ব্লকে একটি বা দু’টি স্কুলের পরিকাঠামো উন্নত করেই বা কতটুকু লাভ হবে, সে প্রশ্নও উঠতে পারে। আশঙ্কা হয়, অন্য অনেক প্রকল্পের মতো এটিরও মূল কথা দেখনদারি— তাতে ছাত্রছাত্রীদেরও কোনও লাভ হল কি না, সে প্রশ্ন নিতান্তই পারিপার্শ্বিক।

কোভিড অতিমারির পরে ভারতে স্কুলশিক্ষার সঙ্কট এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। স্কুলছুটের সমস্যা, শ্রেণি-অনুসারে পাঠ আয়ত্তে ঘাটতির যে চিত্র সামনে এসেছে, তার নিরসনই আজ শিক্ষার সব উদ্যোগের কেন্দ্রে থাকার কথা। সেখানে স্কুল ভবনে পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি যোগ করা কেন অগ্রাধিকার পাবে? কেনই বা স্কুল উন্নয়নের পরিকল্পনায় রাজ্যের মতামত গুরুত্ব পাবে না? তবে প্রশ্নটি কেবল রাজ্য আর কেন্দ্রের অধিকারের সংঘাতেই সীমাবদ্ধ নেই। স্কুলের সঙ্গে এলাকাবাসীর গভীর আবেগ জড়িত থাকে, স্কুল তাঁদের আত্মপরিচয়ের একটি মাত্রা। বহু স্কুলে এলাকার কোনও শ্রদ্ধেয়, জনপ্রিয় মানুষের নামাঙ্কিত। দেশের উচ্চতম প্রশাসনিক পদের মর্যাদাও সেই মানুষটির নামকে অতিক্রম করতে পারে না, যিনি তাঁর সমস্ত সঞ্চয় দান করেছেন শিশুদের শিক্ষার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর নাম জুড়লে সত্যিই স্কুলের ‘শ্রী’বৃদ্ধি হবে কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Government project Schools Central Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE