একটি ডিমের দাম যেখানে সাত টাকা, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মিড-ডে মিলের বরাদ্দ বাড়িয়ে মাথাপিছু ছ’টাকা উনিশ পয়সা ধার্য করল কেন্দ্রীয় সরকার। এর মধ্যে কেন্দ্রের ভাগ সাড়ে পাঁচ টাকার মতো। শিশুদের খাদ্যের অধিকার, সুষম পুষ্টির অধিকার নিশ্চিত করার যে দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের রয়েছে, বছর দেড়-দুই অন্তর কয়েক পয়সা বরাদ্দ বাড়ালেই তার পালন হয়ে যায়, এই হল কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান। গত দশ বছরে এর ব্যতিক্রম দেখা গেল না। এমনকি প্রকল্পের নাম বদলে, ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদের নামটি প্রকল্পের নামে যোগ করে, ‘পোষণ শক্তি নির্মাণ যোজনা’-র মতো গালভরা নাম দিয়েও শিশুর পুষ্টির চাহিদা এবং খাদ্যের বাজার দরের সঙ্গে সরকারের টাকার জোগানের সাযুজ্য হল না। মিড-ডে মিল প্রকল্পের রন্ধনকর্মীদের প্রতি কেন্দ্রের মনোভাব আরও নিষ্করুণ। ২০০৯ সালে মিড-ডে মিল কর্মীদের বেতন ধার্য হয়েছিল মাসে এক হাজার টাকা, আজও বাড়েনি। এর মধ্যে ছ’শো টাকা দেয় কেন্দ্র। সম্প্রতি একটি প্রশ্নের উত্তরে সংসদে শিক্ষা মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী জয়ন্ত সিংহ জানিয়েছেন, ওই কর্মীরা সমাজসেবী, এই টাকাটা তাঁদের সাম্মানিক। প্রশ্ন উঠতে পারে, খাদ্যের দাম যেখানে গত পনেরো বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে, সেখানে ‘সাম্মানিক’ একই অঙ্কে আটকে থাকলে কি কর্মীর সম্মানহানি হয় না? বিশেষত ওই রন্ধনকর্মীরা অধিকাংশ দলিত-জনজাতি পরিবারের মহিলা, তাঁরা অত্যন্ত দরিদ্র। স্কুলের শিশুদের রান্না করে খাওয়ানোর কাজটি তাঁদের একমাত্র কর্মনিযুক্তি, রোজগারের একমাত্র উপায়। তাকে ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ আখ্যা দিয়ে সামান্য কিছু টাকা ধরালে সেটা সামাজিক অন্যায় বলে গণ্য না করে উপায় থাকে না। জনপ্রতিনিধিদের এ সব কথা অজানা থাকার কথা নয়, অথচ সরকার এই সহজ সত্যগুলিকে কেবলই অস্বীকার করে আসছে।
কেন্দ্রের বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়, এই আপত্তি তুললেই কেন্দ্রীয় সরকার বাঁধা উত্তর দেয়— রাজ্যগুলো চাইলে মিড-ডে মিল কর্মীদের বেতন, অথবা খাদ্যের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে পারে। অনেক রাজ্যই তা করে। কেরল মিড-ডে মিল কর্মীদের ৬০০ টাকা দৈনিক মজুরি দেয়, হরিয়ানা দিচ্ছে মাসে ৭০০০ টাকা, পুদুচেরি ১২০০০ টাকা, ওড়িশা ৩০০০ টাকা। এ ছাড়া নানা ধরনের ভাতা, অবসরকালীন টাকা, দুর্ঘটনা বিমা প্রভৃতি নানা রকম সুবিধা নানা রাজ্যের সরকার দেয়। কেন্দ্রীয় প্রকল্প হলেও, কর্মীদের প্রাপ্য সুবিধায় কোনও সমতা নেই। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৩ সালে মিড-ডে মিল কর্মীদের ১৫০০ টাকা মজুরি ধার্য হয়েছিল, এ বছর তা ২০০০ টাকায় পৌঁছেছে। খাদ্যের মূল্যস্ফীতির অনুপাতে এই বৃদ্ধি অতি সামান্য। খাদ্যের পুষ্টিগুণ বাড়াতে বিভিন্ন রাজ্য বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করেছে। কর্নাটক যেমন একটি বিশেষ প্রকল্প চালু করেছে, যার অধীনে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের সপ্তাহে তিন দিন দুধ দেওয়া হচ্ছে। তামিলনাড়ু সরকার নবম, দশম শ্রেণিতেও মিড-ডে মিল দিচ্ছে, রাজ্যের বরাদ্দ ধরে সে রাজ্যে শিশুদের দৈনিক মাথা পিছু বরাদ্দ ৯ টাকা ১৭ পয়সা।
বর্তমান বরাদ্দ থেকে যে যথেষ্ট প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাদ্য শিশুদের দেওয়া যায় না, তা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা হলে এই বরাদ্দ বাড়াচ্ছে না কেন? গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে কয়েক মাস মাথাপিছু সপ্তাহে কুড়ি টাকা বাড়তি বরাদ্দ করেছিল সরকার, নির্বাচন মিটে যেতেই তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এমন নয় যে জনকল্যাণে নানা অনুদান সরকার দেয় না। বরং নানা ধরনের অনুদানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বহু বিতর্ক হচ্ছে। দরিদ্রশিশুর পুষ্টি, এবং দরিদ্র মেয়েদের মজুরি, এ দু’টির থেকে পুজো-মেলা প্রভৃতি কী করে অধিক গুরুত্ব পায়, তা সত্যিই বোঝা কঠিন। কেন্দ্রের কার্পণ্য যেমন অর্থহীন ও ক্ষতিকর, তেমনই আশ্চর্য রাজ্যের অগ্রাধিকার নির্ধারণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy