ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেল ১৯৪৭ সালে সিভিল সার্ভিসের নবীন আধিকারিকদের প্রতি সম্ভাষণে সর্বভারতীয় প্রশাসনিক সংস্থানকে ইস্পাত কাঠামো (স্টিল ফ্রেম) বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। তদবধি বহুব্যবহৃত এই অভিধাটি যে ঋজু দৃঢ়তার প্রতীক, আইএএস তথা আইপিএস আদি অন্যান্য সর্বভারতীয় প্রশাসনযন্ত্র তাহার যথেষ্ট মর্যাদা রাখিতে পারে নাই, সাড়ে সাত দশকের অবকাশে তাহার আচরণে বহু ত্রুটি হইয়াছে, ঘটিয়াছে প্রভূত বিচ্যুতি। কিন্তু সকল ঘাটতি সত্ত্বেও, মানিতেই হইবে, কাঠামোটি জোরদার। ইস্পাতের গুণমান আরও অনেক উন্নত হইতে পারে, কিন্তু তাহা আজও নিম্নমানের লোহায় পরিণত হয় নাই। এই সাফল্যের একটি বড় কারণ: সুস্থ রীতি। আমলাতন্ত্র কী ভাবে চলিবে, তাহাকে কী ভাবে চালানো হইবে, সেই বিষয়ে আইন এবং কর্মবিধি বিস্তর, ক্রমাগত সম্প্রসারণ ও পরিমার্জনের মধ্য দিয়া তাহা আড়ে-বহরে বাড়িয়াছে; কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র বাস্তবে যন্ত্রমাত্র নহে, আইনকানুন ও বিধিনিয়ম দিয়া তাহার বিশাল, বিস্তীর্ণ ও জটিল কাজকর্মকে বাঁধা যায় না, শেষ অবধি সুস্থ এবং সুষ্ঠু প্রশাসন পরিচালনার জন্য সেই যন্ত্রের সর্বস্তরে বোঝাপড়া ও সহযোগিতা অপরিহার্য, তাহাই এক অর্থে সুশাসনের ভিত্তিস্বরূপ।
প্রশাসনের এই ভিতটিতেই নূতন আঘাত পড়িতেছে কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্নিবার আধিপত্যবাদের প্ররোচনায়। রাজ্য হইতে আইএএস, আইপিএস, আইএফএস অফিসারদের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাজ করিবার যে ব্যবস্থাটি আছে, তাহা এত দিন কেন্দ্র ও রাজ্যের সহযোগিতা এবং বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই চালিত হইয়া আসিতেছে। সেই অভিজ্ঞতা সতত সুখের হয় নাই, দুই তরফের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লাগিয়াই থাকে, কখনও কখনও তাহার মাত্রা চড়িয়াও যায়, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে ভারসাম্য বজায় রাখিয়াই ব্যবস্থাটি সচল থাকে। নরেন্দ্র মোদীর সরকার সম্প্রতি জানাইয়াছে, অতঃপর রাজ্য হইতে অফিসারদের দিল্লিতে পাঠাইবার প্রশ্নে কেন্দ্র-রাজ্য মতানৈক্য উপস্থিত হইলে এবং পূর্বনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাহার মীমাংসা না হইলে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই বহাল হইবে। অর্থাৎ, কেন্দ্র যে অফিসারকে চাহিবে, রাজ্য কার্যত তাঁহাকে ছাড়িতে বাধ্য হইবে। গদিতে বসিয়া যিনি ‘সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা’র গালভরা স্লোগান দিয়াছিলেন, আধিপত্য বিস্তারের অখিল ক্ষুধায় সেই প্রধানমন্ত্রী এখন যুক্তরাষ্ট্রের কফিনে এককেন্দ্রিকতার আরও একটি পেরেক ঠুকিতে ব্যগ্র।
কেবল প্রশাসনিক আধিপত্য নহে, রাজনৈতিক আধিপত্যও। বস্তুত, দ্বিতীয়টিই সম্ভবত প্রধান লক্ষ্য। আধিকারিকদের যথেচ্ছ ভাবে কেন্দ্রে ডাকিয়া পাঠাইবার অধিকার হস্তগত করিতে পারিলে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকরা তাঁহাদের চাপে রাখিতে পারিবেন, বিরোধী দল শাসিত রাজ্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে পারিবেন। কেন্দ্রের নূতন উদ্যোগটিতে সর্বভারতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাটিকে দলীয় রাজনীতির স্বার্থে অপব্যবহারের এই উদ্দেশ্যটি রীতিমতো প্রকট। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের এই অন্যায় এবং অনৈতিক চেষ্টার প্রতিবাদে প্রধানমন্ত্রীকে একাধিক চিঠি লিখিয়া যে প্রতিবাদ জানাইয়াছেন, তাহা কেবল সঙ্গত নহে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবাদ হয়তো অন্য রাজ্যও করিয়াছে বা করিবে, কিন্তু এই প্রশ্নে রাজ্য সরকারগুলির সমবেত প্রতিরোধ জরুরি, গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্যই জরুরি। রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাজনীতির ক্ষুদ্রস্বার্থে ব্যবহার করিবার ব্যাধি হইতে কোনও রাজ্য, কোনও দল মুক্ত নহে। এই মুহূর্তে কেন্দ্রের নাগপাশ বিস্তারের অপচেষ্টাকে প্রতিহত করাই প্রথম কর্তব্য। শুভবুদ্ধি বা গণতান্ত্রিকতার প্রেরণায় বর্তমান শাসকরা পিছু হটিবেন বলিয়া ভরসা করিবার অবকাশ তাঁহারা রাখেন নাই। সংগঠিত গণতান্ত্রিক প্রতিরোধই সম্ভবত একমাত্র পথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy