Advertisement
২০ জানুয়ারি ২০২৫
Narendra Modi

নজরদারির সংবাদ

আপন সীমাবদ্ধতার লজ্জা ও বেদনা লইয়াও ভারতের সাংবাদিক নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তির সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরী।

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২১ ০৪:৫৭
Share: Save:

নরেন্দ্র মোদীর বাসনা, তাঁহার সহিত সংবাদমাধ্যমের সম্পর্কটি হইবে ভাশুরের সহিত ভাদ্রবধূর ন্যায়। সাংবাদিক তাঁহাকে দূর হইতে গড় করিবে, প্রশ্ন করিবার স্পর্ধা তাহার কল্পনাতেও আসিবে না। হায়, ভারতের সাংবাদিক বড়ই বুদ্ধিহীন। এমন সুবিধাজনক ব্যবস্থাটি মানিতে রাজি নহে। কখনও তাহারা কোভিড-মৃতের হিসাব চাহিয়া শোরগোল তোলে, কখনও সরকারি তথ্যের সত্যতা যাচাই করিতে শ্মশান কিংবা গোরস্থানে পড়িয়া থাকে, গঙ্গার জলে ভাসিয়া-যাওয়া মৃতদেহের ছবি তুলিয়া আনে। সরকার যাহা বলে তাহাই সত্য, সরকার যাহা বলে নাই তাহা ঘটে নাই— মূর্খ সাংবাদিক এই সরল নিয়মটি আজও বোঝে নাই। অঙ্কের প্রথম ধাপেই যাহারা এমন ভুল করিয়া বসিয়াছে, সেই সব সংবাদসংস্থার হিসাবের খাতার উপর কি সরকার ভরসা করিতে পারে? একটি জাতীয় স্তরের পত্রিকার আয়কর মিলাইয়া দেখিতে অগত্যা আধিকারিকদের পাঠাইতে হইল কেন্দ্রকে। বকেয়া কর আদায় এ ক্ষেত্রে নিমিত্তমাত্র— রাজার নিকট উহা টুনির ধন। কোভিড-মৃতদের প্রকৃত সংখ্যা দেখাইয়া টুনটুনি রাজার নাক কাটিয়াছে, তাহাতে রাজার রাগ। বাস্তবিক, সংবাদের সামনে পড়িয়া এমন ‘দাওয়াই’ ইতিপূর্বেও প্রয়োগ করিয়াছে কেন্দ্র। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, আয়কর, সিবিআই— অপরাধ দমনের জন্য সৃষ্ট এই প্রতিষ্ঠানগুলি সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের বিরুদ্ধে বার বার অভিযান চালাইয়াছে। ইহা আশ্চর্য নহে। সরকারি বচনের বাহিরে অপর কোনও সত্য থাকিতে পারে, এই চিন্তাটিই আজ যেন ‘অপরাধ’ হইয়া উঠিয়াছে। তাই সন্ত্রাসবাদী, পাচারকারীদের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে স্থান হইয়াছে চল্লিশ জন ভারতীয় সাংবাদিকের— তাহাদের ফোনে আড়ি পাতা হইয়াছে, এমন আশঙ্কা দেখা দিয়াছে। ‘পেগাসাস’ কেলেঙ্কারি ভারতে সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি কালিমালিপ্ত মাইলফলক।

সত্য অমূল্য, কিন্তু সত্যকথনের যে মূল্য চুকাইতে হইতেছে ভারতের সাংবাদিক তথা সংবাদমাধ্যমকে, তাহা বড় কম নহে। প্রধানত তিন ভাবে তাহার উপর আক্রমণ আসিতেছে। প্রথম, সাহসী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নানাবিধ কঠোর আইনের প্রয়োগ। মানহানির মামলা এখন জলভাত হইয়াছে— সন্ত্রাস, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে প্ররোচনা, দলিত নির্যাতন প্রভৃতি ভয়ানক অপরাধে সাংবাদিকদের অভিযুক্ত করা হইতেছে। অভিযোগের সারবত্তা লইয়া সরকারের চিন্তা নাই, অন্য সাংবাদিকদের যথেষ্ট শিক্ষা হইল কি না, আনুগত্যের পাঠ আয়ত্ত হইল কি না, তাহাই বিবেচ্য। কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের গ্রেফতারি বস্তুত সকল সাংবাদিকের প্রতি একটি প্রকাণ্ড হুমকি। দ্বিতীয়, সংবাদ দফতরে অনিয়মের অভিযোগে আয়কর, সিবিআই প্রভৃতি কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত, যাহা সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে বিব্রত, ব্যাহত করে। তৃতীয়, সরকারি বিজ্ঞাপন আটকাইয়া ‘শাস্তি’ দিবার চেষ্টা। আনুগত্য কিনিবার এমন নির্লজ্জ প্রয়াসে মোদী সরকার যেন পূর্বের সকল সরকারকে অতিক্রম করিয়াছে।

এত চেষ্টার পরেও সাংবাদিকের বোধোদয় না হইলে রহিয়াছে শেষ অস্ত্র— প্রহার, প্রাণনাশ। মোদী সরকারের প্রথম পাঁচ বৎসরে চল্লিশ জন সাংবাদিক নিহত হইয়াছেন, প্রায় দুই শত জন গুরুতর আহত হইয়াছেন। সংবাদের স্বাধীনতার সূচকে আজ ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২। আপন সীমাবদ্ধতার লজ্জা ও বেদনা লইয়াও ভারতের সাংবাদিক নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তির সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরী। অবজ্ঞা, উপহাস, সন্দেহ, রাষ্ট্রক্ষমতার সাঁজোয়া গাড়ি, সবই তাঁহাদের উপর দিয়া চলিতেছে। তবু অগণিত সাংবাদিক আজও নিজ কর্তব্যে স্থির। এইখানেই পঁচাত্তর বৎসরের গণতন্ত্রের জোর। গণতন্ত্রের হৃত জমি উদ্ধার করিবার অনন্ত যুদ্ধ চলিতেছে— নজরবন্দি কিংবা কারাবন্দি হইবার ঝুঁকি সত্ত্বেও।

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy