গৃহশ্রম।
গৃহপরিচারিকাদের একটি সংগঠন সম্প্রতি ঘণ্টায় সত্তর টাকা হারে বেতন, মাসে চার দিন ছুটি, এবং পুজোর বোনাস দাবি করেছে। তা নিয়ে সমাজমাধ্যমে অনেক প্রশ্ন তুলেছেন গৃহস্থরা। যেমন, ঘণ্টাপ্রতি কাজের পরিমাপ হবে কী করে? না-বলে ছুটি নিলে বেতন কাটার অধিকার থাকবে কি না? বলা বাহুল্য, যাঁরা এ প্রশ্নগুলি করছেন, তাঁদের কর্মক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় তাঁদের কাজের পরিমাপ করা হয় কি না, কিংবা বছরে কত দিন সবেতন ছুটি তাঁরা পেয়ে থাকেন, সে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলে গণ্য হন, তাঁদের অসহায়তার সুযোগ নিতে সকলেই অভ্যস্ত। অতএব মধ্যবিত্ত যে নিজের কাজের মূল্য, এবং নিজের গৃহপরিচারিকার কাজের মূল্য ভিন্ন মানদণ্ডে বিচার করবে, তা আশ্চর্য নয়। পরিচারিকার উপর সন্তুষ্ট গৃহস্থ বড়ই বিরল। ‘কাজের মেয়ে’-কে নিয়ে অনেক নালিশ— তাঁরা নাকি অলস, অদক্ষ, অপরাধপ্রবণ। তবু এই দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত নারীশ্রমিকরাই লক্ষ লক্ষ গৃহ জঞ্জালমুক্ত করছেন, বৃদ্ধ ও শিশুদের পরিচর্যা করছেন, হরেক রুচির রান্না করে সাজিয়ে রাখছেন। সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের বৃহত্তর অংশের কর্মজীবন এই অসংগঠিত মহিলাকর্মীদের গৃহশ্রমের উপর নির্ভরশীল।
অথচ, গৃহপরিচারিকাদের কাজের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সুরক্ষার অভাব দুই-তিন দশক আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনই রয়ে গিয়েছে। প্রথমত, তাঁদের রোজগারের সুরক্ষা যে কার্যত শূন্য, তা কোভিড অতিমারিতে স্পষ্ট হয়েছে। অগণিত পরিচারিকা এই কঠিন সময়ে নিয়োগকর্তাদের থেকে কোনও সহায়তাই পাননি, এমনকি বকেয়া বেতন অবধি পাননি। এক দীর্ঘ সময় ধরে পরিচারিকারা ‘বিপজ্জনক’ বলে পরিগণিত হয়েছেন, আবাসনগুলিতে তাঁদের প্রবেশাধিকার ছিল না। দ্বিতীয়ত, প্রায়ই মিথ্যা অভিযোগে থানায় হয়রানির মুখে পড়তে হয় তাঁদের। পুজোর বোনাসের দাবি করলে গৃহস্থ চুরির অভিযোগ করেছেন, এমন ঘটনাও সংবাদে এসেছে। গৃহশ্রমিকদের কর্মনিরাপত্তা বলে কিছু নেই। তৃতীয়ত, যৌন হয়রানি বহু গৃহশ্রমিকের জীবনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা। কেবল নিয়োগকর্তার পরিবারের সদস্যরাই নয়, বৃহৎ আবাসনগুলির নানা স্তরের কর্মীদের হাতেও তাঁদের নানা ভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়। বহু ক্ষেত্রে শৌচাগার ব্যবহারের উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা থাকে, যা কার্যত হয়রানি। গৃহপরিচারিকাদের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলাদের উপর যৌন হয়রানির প্রতিকারের জন্য জেলাশাসকের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলায় কমিটি প্রস্তুত করার কথা। প্রায় কোনও জেলাতেই তা গঠিত হয়নি, হলেও শ্রমজীবী মেয়েদের কাছে সে খবর পৌঁছয়নি। তাঁদের বিপন্নতা আজও অপ্রতিহত। অসম্মান ও হয়রানি মুখ বুজে সহ্য করবার শর্তে কয়েক লক্ষ মেয়ে রোজগার করে চলেছেন।
ভারতে গৃহশ্রমিকদের সংখ্যা দু’কোটি থেকে আট কোটির মধ্যে, মনে করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। তাঁদের অধিকাংশই মহিলা। গৃহশ্রম অনেক রাজ্যে মেয়েদের সর্ববৃহৎ নিয়োগক্ষেত্র। কিন্তু এই বিপুল কর্মী-বাহিনীর রোজগার নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার সুরক্ষার জন্য এখনও অবধি কোনও আইনি পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। ২০০৮ সালে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য আইন প্রস্তুত করে কেন্দ্র, কিন্তু অধিকাংশ রাজ্যই তা গ্রহণ করেনি। ২০১৭ সালে গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষায় একটি খসড়া নীতি তৈরি হয়, কিন্তু তা-ও কার্যকর হয়নি। গৃহশ্রমিকদের উপযুক্ত আবাসন এবং অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাও করেনি কোনও পুরসভা, বড় জোর তাঁদের জন্য বরাদ্দ সুলভ রেলের পাস। শ্রমের মর্যাদা, নারীর সম্মান আদায়ের জন্য গৃহশ্রমিকদের লড়াই অব্যাহত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy