Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
R G Kar Medical College And Hospital Incident

নীরবতার অপরাধ

নাগরিক সুরক্ষিত কি না, রাষ্ট্র তার কর্তব্য করছে কি না, সে সম্পর্কে সকলকে আশ্বস্ত করা মহিলা কমিশনের কাজ। নীরব থেকে কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় নিজের দায় এড়াচ্ছেন।

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২৪ ০৬:৪৫
Share: Save:

আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে অগণিত কণ্ঠ থেকে উত্থিত স্বরের মধ্যে কয়েকটি নীরবতার গহ্বর প্রকট হয়ে উঠেছে এ রাজ্যে। তার অন্যতম রাজ্য মহিলা কমিশন। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতালে, নিজের কর্মক্ষেত্রে এক চিকিৎসক-পড়ুয়ার ধর্ষণ ও মৃত্যু, এই ভয়ঙ্কর ঘটনা এ রাজ্যে তো বটেই, এ দেশেও অভূতপূর্ব। দেশ-বিদেশ যখন আন্দোলিত হল বিচারের দাবিতে, তখন টুঁ শব্দটি শোনা গেল না রাজ্য মহিলা কমিশনের মুখে। অথচ, সবার আগে সরব হওয়ার কথা তাদেরই। এক কর্মরত মহিলাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার জন্য পুলিশ-প্রশাসনের সমালোচনা করা, এবং যথাযথ তদন্তের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা ছিল। প্রশাসনকে সতর্ক করা, হাসপাতালে সন্ত্রস্ত ছাত্রছাত্রী, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আশ্বস্ত করার কথা ছিল। এটাই কমিশনের সংবিধান-প্রদত্ত ভূমিকা। কমিশনকে এই বিশেষ ক্ষমতা দেওয়ার কারণ রয়েছে। প্রায়ই দেখা যায় যে নারীহিংসার পরে প্রভাবশালী পক্ষ প্রশাসনের সহযোগিতায় একটা মিথ্যা বয়ান জোর করে চালানোর চেষ্টা করে। আক্রান্তের পরিবারকে আড়াল করা, পাড়া-পড়শি বা সহকর্মীদের হুমকি দিয়ে চুপ করানো, সাংবাদিকদের এলাকায় ঢুকতে বাধা দেওয়া, মানবাধিকার কর্মীদের ‘বিরোধী’ বলে আটকানো— সব রকম চেষ্টা দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত ঘটনা সর্বসমক্ষে আনার দায় মহিলা কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের মতো স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির।

নাগরিক সুরক্ষিত কি না, রাষ্ট্র তার কর্তব্য করছে কি না, সে সম্পর্কে সকলকে আশ্বস্ত করা মহিলা কমিশনের কাজ। নীরব থেকে কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় নিজের দায় এড়াচ্ছেন। আইনি সুরক্ষার বর্ম পেয়েও লড়াই করে না, এমনই রক্ষী জুটেছে এ রাজ্যের মেয়েদের! কুশমণ্ডি, বগটুই, হাঁসখালি, সন্দেশখালি— নারী-নির্যাতনের নানা ভয়ঙ্কর ঘটনায় রাজ্য তোলপাড় হয়েছে। অথচ, মহিলা কমিশন বা মানবাধিকার কমিশনের কাছ থেকে রাজ্যের প্রতি কোনও তিরস্কার, সমালোচনা, নির্দেশ বা সুপারিশ শোনা যায়নি। তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল আর জি কর-কাণ্ডে। পরিস্থিতি এমনই, যে রাজ্যের মহিলা কমিশন বা মানবাধিকার কমিশন কী বলছে, সে খোঁজও কেউ আর করেন না। মহিলা কমিশন বা মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অতীতেও। বর্তমান জমানায় যেমন, অতীতের বাম জমানাতেও এই প্রশ্ন উঠেছে। রিজওয়ানুর রহমানের অপমৃত্যুর পরবর্তী ঘটনাক্রমে তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, নন্দীগ্রামে ‘সূর্যোদয়’-এর পরেও। তবু কমিশনের অস্তিত্ব অন্তত অনুভব করা যেত। এমনকি, ২০১১ সালের ‘পরিবর্তন’-এর পরেও কমিশনের ভূমিকা একেবারে অকিঞ্চিৎকর হয়ে যায়নি। ২০১২ সালে পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের পরে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব নিয়ে কমিশন বিদ্ধ করে প্রশাসনকে। অর্থাৎ, যতই মৃদু আঘাত করুক, সরকারকে ঠিক পথে চালানোর অঙ্কুশটি প্রকাশ্যে হাতে রেখেছিল কমিশন।

আজ সেই অঙ্কুশ কই? বার বার সন্দেহ জাগছে, সরকার সত্য গোপন করছে, প্রমাণ নষ্ট করছে, মূল অভিযুক্তদের আড়াল করছে। হতে পারে এ মিথ্যা সন্দেহ, কিন্তু বিভ্রান্তি অপসারণ করে সত্য, ন্যায়ের পথ দেখানো, সুবিচারের আশ্বাস দেওয়ার কাজটি করবে কে? মুখ্যমন্ত্রী একই সঙ্গে বিচারপ্রার্থী এবং বিচারদাতার ভূমিকা নিচ্ছেন। রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের উপর আস্থার সঙ্কট অনুভব করে নিজেই একটা সময়সীমার পরে পুলিশের হাত থেকে তদন্ত সরিয়ে সিবিআইকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ, রাজ্যের বিধিব্যবস্থাতেই পুলিশি তদন্তের উপরে নজরদারির প্রতিষ্ঠান ছিল। স্বতন্ত্র কমিশনগুলিকে দাঁতনখহীন করে রাখার আপাত-সুবিধার পিছনে রয়েছে যে সঙ্কট, তা হয়তো এ বার টের পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। মহিলা কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট না করলে, আজ রাজ্যের উপর আস্থা ফেরানোর একটা উপায় থাকত হাতে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy