Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Winter in West Bengal

অগ্নিবলয়

নাগরিক বলতেই পারেন, শীতের পথে বাধার প্রাচীরগুলি যদি একের পর এক মাথা তুলতেই থাকে, তা হলে সেগুলি ‘সাময়িক’ জেনে আর লাভ কী হল?

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৪১
Share: Save:

শবরীর প্রতীক্ষাও শেষ অবধি হার মেনেছে। ২০২৩ সালের শেষ অবধি। ডিসেম্বরের শুরু থেকে সোয়েটার, কম্ফর্টার, কান-ঢাকা টুপি ইত্যাদি ঢাল-তরোয়াল সহকারে বঙ্গসমাজ প্রস্তুত ছিল, শীত আসেনি। বড়দিনের মাহেন্দ্রক্ষণেও শহরের পথে দু’পা হাঁটতে না হাঁটতেই গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত, নামবিভ্রাটের ঠেলায় মরুভূমির মাঝখানে গিয়ে পড়া গুপী-বাঘার মতোই গা থেকে গরম পোশাক খুলে ফেলে সারা দিন তার ভার বইতে বইতে নাগরিক প্রশ্ন করেছেন: শীত, তুমি কি তবে আসবে না? হাওয়া অফিস থেকে আশ্বাস মিলেছে: আসবে, আর ক’দিন পরে। পুরনো বছর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানিয়েছে: আমি তো আর নাই! বোধ করি সেই আর্তিতে সাড়া দিয়েই বর্ষান্তের দিনটি থেকে আবহাওয়া ঈষৎ সদয় হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই জারি আছে সেই কঠিন প্রশ্ন: এই শীতটুকু ক’দিন টিকবে?

কেন এই অবস্থা? শীতের পথ আটকাল কে? হাওয়া অফিসের জবাব: উচ্চচাপ। মধ্য ভারতের বায়ুমণ্ডলে ডিসেম্বরের মধ্যপর্বে তৈরি হয়েছে এক প্রবল উচ্চচাপের বলয়। উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে ভেসে আসা শীতল বাতাসকে সে দিনের পর দিন এ দিকে ঘেঁষতে দেয়নি, তার বদলে উল্টো দিক থেকে বঙ্গোপসাগরের জলীয় বাষ্প ঢুকে শীতসোহাগি বাংলার ভাগ্যাকাশ ভারী করে রেখেছে। এই দুঃসংবাদের পরে আশ্বাসও মিলেছে আবহবিদদের কণ্ঠে— এই উষ্ণতা সাময়িক, এ বার উচ্চচাপের প্রাচীর সরবে। সেই আশ্বাস মিথ্যে হয়নি, হাওয়া ঘুরেছে, মৃদুমন্দ হিমের পরশ পেয়েই বঙ্গজন পরম আহ্লাদে বলছেন: পরা যাক দু’চারটে জ্যাকেট এ বার। তাঁরা জানেন, ‘শীতকাল’ বলে এই ভূখণ্ডে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, উচ্চচাপ আর নিম্নচাপের অবিরত লীলায় বছরের পর বছর বাতাসে হিমের পরশ ক্ষণস্থায়ী থেকে আরও ক্ষণস্থায়ী হয়ে চলেছে, তার শীতলতার মাত্রা যৎকিঞ্চিৎ থেকে ক্রমে অকিঞ্চিৎকর।

নাগরিক বলতেই পারেন, শীতের পথে বাধার প্রাচীরগুলি যদি একের পর এক মাথা তুলতেই থাকে, তা হলে সেগুলি ‘সাময়িক’ জেনে আর লাভ কী হল? এই সূত্র ধরেই অতঃপর উঠে আসে অনিবার্য প্রশ্নটি: বায়ুমণ্ডলে চাপসৃষ্টির বহর এমন বেড়েছে কেন? এবং তার পায়ে পায়ে আবির্ভূত হয় গভীর উদ্বেগের স্বর: এই প্রবণতা কি তবে বিশ্ব উষ্ণায়নের পরিণাম? জলবায়ু ও আবহাওয়ার বিজ্ঞানে এমন প্রশ্নের সহজ এবং একমাত্রিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, বিজ্ঞান ধর্মগুরুদের ভাষায় কথা বলে না। কিন্তু দীর্ঘ ও বিশদ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা এখন এই কথাটি জোরের সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা না কমালে এবং ভূমিক্ষয় ও অরণ্য ধ্বংস-সহ প্রকৃতি-সংহারের রকমারি ধ্বংসকাণ্ড রোধ না করলে বিশ্ব পরিবেশ যে সর্বনাশের কানাগলিতে প্রবেশ করেছে সেখান থেকে তার নিষ্কৃতি নেই। ঋতুচক্রের অস্বাভাবিক পরিবর্তন সেই সর্বনাশের একটি দিক, এমন আশঙ্কা উত্তরোত্তর প্রবলতর আকার ধারণ করছে। দুনিয়া জুড়ে এই অস্বাভাবিকতার নিদর্শনগুলি ক্রমশই বেড়ে চলেছে, বিশেষত উত্তর গোলার্ধের শীতপ্রধান দেশগুলিতে অভূতপূর্ব গ্রীষ্মের তাড়নায় ইতিমধ্যেই বড় আকারের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। ঘরের কাছেও সেই সঙ্কটেরই আভাস মিলল এই শীতে। খোলা আকাশের নীচে যখন ভরা পৌষের অপরাহ্ণও অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন সেই রৌদ্রতাপে নিহিত থাকে এক বিপুল বিপর্যয়ের আঁচ, যে বিপর্যয় থেকে পৃথিবী নামক গ্রহের নিস্তার পাওয়ার সম্ভাবনা দ্রুত কমে আসছে। যদি এই গ্রহের অধিবাসীরা এখনও সেই উত্তাপ যথেষ্ট অনুভব করতে না পারে, ‘এ ভাবেই চলছে চলবে’ ভেবে ক্ষণিকের শীত উপভোগ করে পরিতৃপ্ত বোধ করে, তবে তাদের পরিণতি হয়তো সেই গল্পের ব্যাঙটির মতোই হবে, যাকে এক জলপাত্রে রেখে অল্প অল্প করে জলের উত্তাপ বাড়ানো হয়, এবং সে এক সময়— বুঝতে না পেরেই— মরে যায়। এ-গল্পে বিজ্ঞানের ফাঁক আছে, কিন্তু তার প্রতিপাদ্য এখন আমাদের পক্ষে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

অন্য বিষয়গুলি:

Temperature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy