প্রধানমন্ত্রীর বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিলে টানা চার মাসের পরিশ্রমে উপার্জিত সব টাকা দান করিলেন সঞ্জয় শাঠে। মাত্র ১০৬৪ টাকা। মহারাষ্ট্রের পুণে জেলার পেঁয়াজচাষি সঞ্জয় মোট সাড়ে সাত কুইন্টাল ফসল ফলাইয়াছিলেন। পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি এক টাকা চল্লিশ পয়সা দরে সেই ফসল বেচিতে বাধ্য হইয়াছেন তিনি। সম্প্রতি দিল্লিতে যে বিপুল কৃষক বিক্ষোভ হইল, সঞ্জয় কি সেখানে উপস্থিত ছিলেন? অথবা, মার্চ মাসে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্ত হইতে যে মিছিল মুম্বই পৌঁছাইল, তাহাতে? সিঙ্গুর থেকে কলিকাতায় হাঁটিয়া আসা মিছিলে? সঞ্জয় শাঠে সেই মিছিলে, সেই বিক্ষোভে ছিলেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর অপ্রয়োজনীয়। কারণ, মিছিলগুলিতে যত কৃষক হাঁটিলেন, রাজধানীর রাস্তায় যাঁহাদের ফুটিফাটা পা বহিয়া লইয়া গেল ক্লান্ত অথচ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শরীরগুলিকে, প্রত্যেকেই সঞ্জয় শাঠে। ভাষা, বর্ণ, বাসস্থানের বিভিন্নতাকে অতিক্রম করিয়া তাঁহাদের এক বিন্দুতে দাঁড় করাইয়া দিয়াছে কৃষক হিসাবে অসহায়তা। তাঁহাদের উৎপন্ন পণ্য দাম পায় না, সরকারের ঘোষিত ন্যূনতম ক্রয়মূল্যও তাঁহাদের হাতে পৌঁছায় না। তাঁহাদের খেতে সেচের জল পৌঁছায় না। ফসল নষ্ট হইলে তাঁহাদের রক্ষাকর্তা নাই। ঋণের পাহাড়ে চাপা পড়িতে থাকা এই কৃষকরা প্রধানমন্ত্রীর সুভাষিত শুনিয়াছেন— পাঁচ বৎসরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করিয়া দিবেন তিনি। চাষের টম্যাটো রাস্তায় ফেলিয়া দিতে দিতে তাঁহারা দেখিয়াছেন, তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মূর্তির উদ্বোধন করিতেছেন প্রধানমন্ত্রী। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিন্দুমাত্র দাম না পাইবার পর তাঁহারা টের পাইয়াছেন, অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণে সরকারের যতখানি আগ্রহ, কৃষকের অবস্থা পাল্টাইতে তাহার তিলমাত্র নহে। মিছিলে পা মিলাইয়া চলা কৃষক যখন দাবি করেন যে মন্দির পরে হইবে, আগে আমাদের রুটির বন্দোবস্ত হউক, সেই নির্ঘোষে শাসকের ঘুম ছুটিয়া যাওয়া স্বাভাবিক।
শাসকরা ভয় পাইয়াছেন বিলক্ষণ। তাঁহারা জানেন, কৃষকদের ক্ষোভের বাড়া দেশজোড়া সমস্যা এই মুহূর্তে আর নাই। এবং, তাঁহারা এই কথাটিও জানেন যে কৃষক বিক্ষোভই বিরোধী রাজনীতিকে সংগঠিত করিতে পারে। দিল্লির সভায় একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন অরবিন্দ কেজরীবাল ও রাহুল গাঁধী, সীতারাম ইয়েচুরি ও শরদ যাদব। ভোটের অঙ্কে কৃষি-ভারত গুরুত্বে অদ্বিতীয়। তাহাকে জাতের অঙ্কে ভাঙিয়া লওয়া যায়, ধর্মের প্রশ্নে তাহাদের মেরুকরণ করা সম্ভব। কিন্তু, সে সবই রাজনীতির কলাকৌশল। পেটে টান পড়িলে যে পরিচয়টি সর্বাগ্রগণ্য হইয়া উঠে, তাহা ভুখা মানুষের পরিচয়। ক্ষুধার সম্মুখে অন্য সব পরিচিতিই দ্বিতীয় সারির। বিরোধী রাজনীতি সেই পরিচিতিকে কাজে লাগাইতে চাহিবে। বস্তুত, কৃষির এই সঙ্কট ভারতের জাতিভিত্তিক রাজনীতিতে বহু আপাত-অসম্ভব সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করিয়া দিতে পারে। যেমন, কেজরীবাল ও রাহুলের সহাবস্থানকে কেহ এই অসম্ভাব্যতার শিল্প হিসাবে দেখিতেই পারেন। অমিত শাহ হয়তো বলিবেন, ‘কুকুর-বিড়ালের জোট’। কর্নাটকে যেমন বলিয়াছিলেন। কিন্তু, নরেন্দ্র মোদীরা জানেন, কৃষির সঙ্কটের তুল্য আর কিছু নাই। জিডিপি-র বৃদ্ধির হার লইয়া তর্জা চলিতে পারে; জিএসটি-র ফলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমিলেও তাহাতে আখেরে যে লাভই হইল, সেই ব্যাখ্যাও তাঁহারা ফাঁদিয়া বসিতে পারেন। কিন্তু, কৃষকের উনানে ভাত না চড়ার প্রসঙ্গটি রাজনীতির কেন্দ্রে চলিয়া আসিলে তর্কের আর কোনও অবকাশ থাকিবে না। এক ওয়াকিবহাল পর্যবেক্ষক বলিয়াছেন, আগে কৃষকরা আত্মহত্যা করিতেন, এখন প্রতিরোধ করিতেছেন। মন্দিরের বদলে রুটি দাবি করিবার রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর অর্জন করিতে পারিয়াছেন। ভোটব্যাঙ্কের বদলে কৃষকরাই যদি মূর্তিমান রাজনীতি হইয়া উঠেন, শাসকরা ভয় পাইবেন বটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy