মিডডে মিল চালু করার ক্ষেত্রে সরকারের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র পরিবারের পড়ুয়াদের দুপুরের খাবারটা স্কুলে সরবরাহ করা।
স্কুলে দ্বিতীয় পিরিয়ড চলছে। শুনলাম, নবম শ্রেণির রুবিনা খাতুন (নাম পরিবর্তিত) মাথা ঘুরে ক্লাসে পড়ে গিয়েছে। তাকে স্টাফ রুমে আনা হল। চোখে-মুখে জল দেওয়ার পরে ধাতস্থ হল। খুব দুর্বল দেখাচ্ছিল রুবিনাকে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী খেয়ে এসেছিস?’ রুবিনা চুপ। বার কয়েক জিজ্ঞাসার পরে সংক্ষিপ্ত উত্তর এল, ‘মুড়ি।’ স্কুলের এক কর্মীকে বললাম, ‘ওকে মিডডে মিল খাইয়ে দাও।’ রুবিনার সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তার বাবা ফের বিয়ে করে অন্যত্র সংসার পেতেছেন। রুবিনা তার মায়ের কাছে থাকে। তার মা বিড়ি বাঁধেন। বড় টানাটানির সংসার। সে দিন সকালে বাড়িতে রান্না হয়নি। রুবিনারও তাই খাওয়া হয়নি। একমুঠো মুড়ি খেয়ে সটান স্কুলে চলে এসেছে। নিট ফল, দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে থাকার ফলে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এর পরে রুবিনাকে বলা হল, রোজ যেন স্কুলে এসে সে মিডডে মিল খেয়ে নেয়। রুবিনা একা নয়, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মিডডে মিলের ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের স্কুলে প্রায় চল্লিশ জন নবম শ্রেণির ছাত্রী নিয়মিত মিডডে মিল খায়।
আসলে মিডডে মিল চালু করার ক্ষেত্রে সরকারের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র পরিবারের পড়ুয়াদের দুপুরের খাবারটা স্কুলে সরবরাহ করা। ভারতের মতো কৃষিনির্ভর দেশে এমন দরিদ্র পরিবারের সন্তানের সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। ওড়িশার কালাহাণ্ডি, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্র সীমার নীচে বাস করা মানুষের কাছে দৈনিক তিন বেলা ক্ষুধা নিবারণ একটি বড় সমস্যা। ক্ষুধা মেটাতে বহু শিশুকে বিদ্যালয় ছাড়তে হয়। গুটিগুটি পায়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলার পরিবর্তে ইটের বোঝা মাথায় তুলতে হয়। লোকের দোকানে বাসন মাজতে হয়, জুতো পালিশ করতে হয়, কাগজ কুড়োতে যেতে হয়। স্কুলে এলেও দেশের এমন হাজার হাজার পড়ুয়া না খেয়ে বা নাম কা ওয়াস্তে কিছু খেয়ে আসে। খিদে পেটে পড়ায় মন বসে না। ওদের কাছে মিডডে মিল শুধুমাত্র দুপুরের টিফিন নয় বরং এক বার পেটপুরে খাওয়া। ওদের কাছে দু’বেলা পেট পুরে গরম খাবার পাওয়া বিলাসিতা।
তাই সরকারের মিডডে মিল সরবরাহের মূল উদ্দেশ্য ছিল, লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুপুরের খাবারটাও যেন পড়ুয়ারা খেতে পায়। পেটে খিদে থাকলে যে পড়ায় মন বসে না! এ ছাড়াও, শিশুদের মুখে একটু পুষ্টিকর খাবার তুলে দেওয়াও ছিল মিডডে মিলের উদ্দেশ্য। যদিও সরকার পুষ্টিকর খাবারের বরাদ্দ কখনও দেয়নি। এখনও দেয় না। তবে, চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়মুখী করতে দারিদ্র যে একটি বড় বাধা সেটা সরকার বুঝেছিল। পাশফেল তুলে দেওয়া, বিনামূল্যে পোশাক, বই, জুতো, খাতা এবং দুপুরের খাবারের একটাই উদ্দেশ্য, চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকে বিদ্যালয়মুখী করা। ওদেরকে শিক্ষিত করা। কারণ, এটা আশা করা হয়েছিল যে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা সন্তানের বাবা-মা অবশ্যই চাইবেন, তাঁর সন্তান শিক্ষিত হোক। এই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া পড়ুয়ারা পরে যখন বাবা-মা হবে তখন তারা তাদের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠটুকু অন্তত দিতে পারবে। যদিও পরিকাঠামো ও সমন্বয়ের অভাবে আজও সকলকে প্রকৃত শিক্ষিত করা গেল না। অষ্টম শ্রেণিতে উঠে আজও অনেকে লিখতে পড়তে শিখল না।
মুশকিল হল, আমাদের অনেকেই মিডডে মিলের এই উদ্দেশ্যগুলো অনুভব করি না। করি না বলেই প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গে রান্না করা মিডডে মিল সরবরাহে আমাদের বেশ অনীহা ছিল। মাসে এক বার শুকনো চাল দিয়েই দায় সারতাম। সরকারি স্তরেও প্রথম দিকে মিডডে মিল সরবরাহ নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না।
আজ, ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে আমরা বলতেই পারি যে, মিডডে মিল একটি প্রাসঙ্গিক, কার্যকরী ও সফল প্রকল্প। মিডডে মিলের সঠিক রূপায়ণের ফলে বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের উপস্থিতি বেড়েছে। অপুষ্টিজনিত সমস্যা কমেছে। হিন্দু, মুসলিম, ধনী, গরিব একসঙ্গে বসে খেতে শিখেছে। আগে একটু সম্পন্ন পরিবারের পড়ুয়ারা স্কুলে লুচি-তরকারি, চাউমিন, বা স্যান্ডউইচের মতো ভাল টিফিন নিয়ে আসত। গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা আনত মুড়ি কিংবা রুটি। টিফিন খাওয়ার সময় ওদের অনেকেই হীনমন্যতায় ভুগত। ভাল টিফিন আনা পড়ুয়াদেরও খারাপ লাগত। স্কুলের পোশাকের মতো, মিডডে মিলও কিন্তু শ্রেণিকক্ষ বা স্কুলে গরিব-বড়লোক, ভেদাভেদ, জাত-ধর্ম মুছে দিয়েছে। এটা কিন্তু কম কথা নয়।
তবে এই আশার আলোর মাঝেও বলতেই হয়, এখনও মিডডে মিল চালু করার উদ্দেশ্যগুলো অনুভব করি না বলেই মিডডে মিল নিয়ে আমাদের অনেকেরই আন্তরিকতা কম। মিডডে মিলের রান্নাঘর নোংরা থাকে। অন্য আনুষাঙ্গিক ব্যবস্থাপনা ভাল থাকে না। খাবারের মান ইচ্ছে করেই এত নিম্নমানের করা হয় যাতে বিদ্যালয়ে আসা পড়ুয়ারা কম খায়। এতে হয়তো কারও ব্যক্তিগত লাভ হয় কিন্তু সমষ্টির ক্ষতি হয়। মিডডে মিলকে গালমন্দ করা যায়।
তা ছাড়া, যে সব স্কুলে সরকার এখনো ডাইনিং হল করে দেয়নি বা স্কুল কর্তৃপক্ষও নিজেরা ডাইনিং হল তৈরি করেননি, সেই সব বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের খাওয়ানোর ব্যবস্থাপনা খুব অমানবিক। (চলবে)
লেখক: প্রধান শিক্ষক, লস্করপুর হাইস্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy