উমা বিদায় নিতেই শুরু হল লক্ষ্মীবরণের পালা। ঘরে চাই স্থায়ী সুখ, নিশ্চিত উন্নতি। তাই এই আনন্দ-আয়োজন। লক্ষ্মী কি বছরে এক বার শ্রী বেঁধে দিয়ে যাবেন ঘরের উঠোন কিংবা ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে? সম্বৎসর মেয়েদের প্রতি অবহেলা কি সফল পুজোপাঠে দূর হবে এক লহমায়? এমন প্রশ্নের শর্তে কি আর আরাধনা হয়? লক্ষ্মীপুজো এক ইতিবাচক আকাঙ্খার অনুসারী। কোনও বিসর্জন নেই।
এই পুজোর অধিকার মেয়েদের নিজের হাতেই। তেল-সিঁদুর-আলতা অনুষঙ্গ আধুনিক মেয়েরা অনেকাংশে ত্যাগ করলেও বদলায়নি হেঁশেলের চাবি আঁচলে বেঁধে রাখার অভ্যাস। তাই এখনও ভালবেসে সংসারে একতরফা শ্রমদান। এখনও সংসার ও সন্তানের মন্দ কিছু হলে তার দায় মাথা পেতে নেওয়া। স্বামীর আজ্ঞা শিরোধার্য না করলে সত্যিই পাপ হবে, সংসারে এই বিশ্বাস এখনও কায়েম। ‘নারীর পরমগতি স্বামী ভিন্ন কেবা’— পাঁচালির এই লাইন বহু মেয়ে মুখস্থ বলতে পারেন। ব্যক্তি ও সামাজিক বিশ্বাসের আধারে সেই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিতও বটে! শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী আধুনিকারা এত দিন ধরে বিষয়টি হেসে ওড়ালেও পাঁচালির মূল ভাষায় কি খুব বেশি বদল ঘটেছে?
দেবীশক্তি আর নারীশক্তি এখন সমার্থক ধরা হয়। আসলে নারীর পাশে এই শক্তিটি বড় বিপজ্জনক। যা আদপেই হাতের মুঠোয় নেই তা উদ্যাপন বড় বেদনার। দেবীদের শক্তিতে আস্থা রাখলেও ঘরের বৌয়ের শক্তিকে কেই বা বিশ্বাস করে! রোজ কুঁকড়ে থাকা বাড়ির সাদামাটা মেয়েটিকেই বা কে মানে! শক্তির উৎস ক্ষমতা। ক্ষমতার রাশ মেয়েদের হাতে এল না। গ্রাম-শহর জুড়ে অত্যাচারের দৃষ্টান্ত বাড়ছে। মেয়েদের সহন করার নজির অসহায় ভাবে সামনে এসে পড়ছে। কিন্তু এ নিয়ে তেমন হেলদোল নেই কারও। ‘আগের চেয়ে ভাল আছে’ বিশ্বাসের জমানায় মেয়েদের নিজের রাস্তা দেখে নেওয়ার স্বাধীনতাও নেই। অগাধ পণে না নেই এমন বেগার খাটা ঘরোয়া মেয়ে সোনার মতো দামি।
সম্প্রতি এক সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল হয়। সেই ফুটেজের বাড়িটি হাইকোর্টের এক প্রাক্তন বিচারপতির। সেখানে দেখা গেল, সুবিন্যস্ত পারিপাটি ঘরে বিচারপতি নিজের হাতে পুত্রবধূকে চুল ধরে মাটিতে ফেলে মারধর করছেন। সারা পরিবার নাগাড়ে হাত তুলে যাচ্ছে। এক বাচ্চা সোফায় বসে দেখছে। ছুটে যাচ্ছে লুটিয়ে পড়া মায়ের কাছে। তাকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার সকলে মারধর করছেন। সোফার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে সে বাচ্চা। অন্য বাচ্চাটি মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে। মারের আসর থেকে বাবা তাকে সরিয়ে দিচ্ছে দূরে। সাত বছর ধরে এই অবস্থা। এক চ্যানেলের সামনে বসে সব জানাচ্ছেন শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত সেই মহিলা। কিন্তু তিনি নিজে ভুল করেছেন এই অত্যাচার এত দিন ধরে সহ্য করে। আরও পণের দাবিতেই এই নির্যাতন।
আর একটি ঘটনা দেশের বড় একটি রাজনৈতিক পরিবারের। শ্বশুরবাড়িতে পুলিশ নিয়ে গিয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাটক খোলে না। এগারো ঘণ্টা অপেক্ষার পরে শাশুড়িকে হত্যা করবে না এমন মুচলেকা দেওয়ার পরে দরজা খুলে যায়। যাদব পরিবারে পুত্রবধূ ঐশ্বর্যা উচ্চশিক্ষিত। রাজকীয় জাঁকজমকে বিয়ে হয়েছিল। ঐশ্বর্যার অভিযোগ, তাঁকে ঘরে আটকে রাখা হয়। খাবার দিতে অস্বীকার করা হয়। এমনকি তাঁর বাবার দেওয়া গয়নাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তারপরে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া হয়। আসলে সমাজের সব স্তরেই মেয়েদের জীবন ও মর্যাদাকে এক সামাজিক ন্যায্যতার নিরিখে মাপা হয়। দিন বদলায়। সভ্যতা এগোয়। কিন্তু সেই মানদণ্ড আধুনিক হয় না। শুধু নির্যাতনের পরিভাষা ও অভিমুখ বদলাতে থাকে।
আবার আইন নিয়ে পড়তে আসা এক গরিব ঘরের ২৩ বছরের মেয়ে নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন। এমন ভিডিয়ো বহু নেটিজেনের নজরে আসে। আইন কলেজের ছাত্রী যাবতীয় রেকর্ড, পেনড্রাইভ ইত্যাদি নিজের সংগ্রহে আছে বলে দাবি করেন। কিন্তু বিচার পান না। উল্টে ব্ল্যাকমেলের অভিযোগে ওই তরুণীকেই জেলবন্দি করা হয়। উন্নাওয়ের ১৭ বছরের মেয়ের উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারের পরেও মিলছে লাগাতার হুমকি। এমন সব পেরেক পোঁতা বধ্যভুমিতে মেয়েরা
হেঁটেই চলেছেন।
পুরুষের ঘটানো যে কোনও বিষয়ে প্রায়ই বলা হয় আসলে ছেলেটা খুব সরল। দোষ নেই। মেয়েটিই শয়তান। অলক্ষ্মী আসলে কোনও বিপদ নয়, মেয়ের প্রতিরূপ। আজীবন পুরুষের মহিলা সংক্রান্ত বিচ্যুতিকে মেয়েটার দোষ বলেই চালানো হয়। প্রশ্ন এত কিছু করেও পুরুষ বেদাগ, ঝকঝকে এবং গৃহকর্তার শ্রদ্ধার আসনে অনড়। অনেক সময় কিছু না করেই মেয়েটি স্বভাবে, আচরণে খুব শয়তান হয়ে যান। আমাদের এই লক্ষ্মী মেয়েতে তাত্ত্বিক বিশ্বাস ও লক্ষ্মী ছেলেদের বাস্তবে অকাতরে প্রশ্রয়দানের মন না বদলাতে পারলে ভিন্ন ফল প্রত্যাশা করা নিরর্থক। বছরভর পুজো করেও দেবী ও মানবীতে ফারাক থাকবেই।
হাতেনাতে স্বামীকে পতিতালয়ে যাওয়ার প্রমাণ ধরার পরেও বহরমপুরের এক মেয়ে আবার স্বামীর কাছে ফিরে যান। সংসার বাঁচানোর শেষ চেষ্টা। সংসারে একা হয়ে গেলেও মরা শিউলির মতো বিষাদের উদ্যাপনও বুঝি জীবন! সমাজবিদ্যায় স্নাতোকোত্তর হয়েও এক উবের চালক স্বামীর নির্যাতন নীরবে সহ্য করে যান কলকাতার এক মেয়ে।
স্বামীর নির্দেশে চার বার গর্ভপাতের পরেও তিনি টিকে থাকেন সংসার নামক পবিত্র স্বর্গে। মদ্যপ স্বামীর প্রতিদিনের মার যখন শরীর নয় আত্মায় ঘা দেয় তখন সম্বিৎ ফেরে। থানায় অভিযোগ দায়ের হয়। সেই অভিযোগও এখন কর্তাদের ‘দেখছি, দেখব’ মর্জির উপর ঝুলে। মেয়ে এখন কাজ করছেন। সামনে লক্ষ্য এম ফিল করা। সংসারে এই সব মেয়েদের মাথায় অলক্ষ্মীর টিকা।
এখন সমাজ-মাধ্যমে অন্য পাঁচালির ঝড় উঠেছে। স্বাধীন, স্বাবলম্বী, শিক্ষিত, সফল নারীরা জায়গা পেয়েছেন সেই পাঁচালিতে। পুজোপাঠের পদ্ধতিতে নতুন শব্দ সংযোজনের দাবি উঠেছে। পণ, গৃহশ্রম, বাল্যবিবাহ, বধূ নির্যাতন, নারী শিক্ষা, ঋতুকালীন ‘অশুচিতা’ ভেঙে লক্ষ্মীর উল্লসিত বরদানের মধ্যে দিয়ে পাঁচালি পাঠের দাবিও উঠেছে। আসলে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর মধ্যযুগীয় ও ভিত্তিহীন এক ধারণার সঙ্গে আজও মেয়েদের লড়তে হয়। সেখানে স্পষ্ট ও সচেতন ছেদ টানতেই এমন উদ্যোগ। পাড়াবেড়ানি, উচ্চস্বরে হা হা হাসির মেয়ের জন্য সংসার যে রসাতলে যায় না সেটাও আজ স্পষ্ট। বরং ওঁদের ইচ্ছে ও ক্ষমতাকে দমনের মধ্যে দিয়েই অশান্তির সূত্রপাত। অধিকার ও পদমর্যাদা হরণের মধ্যে দিয়েই সামজিক ও পারিবারিক বৈষম্যের বিকাশ। বহরমপুরের এক পদস্থ আধিকারিক প্রতারক জেনেও তাঁকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যান স্ত্রী। এই নির্যাতনের কোনও নালিশ হয় না। এই নারীরা সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালেন। উচ্চ হাসিও হাসেন না। তবুও লক্ষ্মীর বরদানে ওঁরা স্বামীর মন পান না। স্বামীর চাল-চলন নিয়ে বেশি প্রশ্ন করলে আবার পাগল বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। সংসারের অলক্ষ্মী তাই বিদায় হবে কী করে? লক্ষ্মী খুশি হয়ে ঘরে বসত করবেন কী ভাবে?
আজও ঘরের শ্রী ধরে রাখতে মেয়েদের অন্যায়ের সঙ্গে সমঝোতা করতে হচ্ছে। মেয়েদের সুনিশ্চিত নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠুক লক্ষ্মীপুজো। তাতেই ফিরবে সমাজ ও পরিবারের সামগ্রিক শ্রী।
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy