ইটণ্ডার প্রাচীন মন্দির। নিজস্ব চিত্র
ইটণ্ডা বোলপুর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অজয় নদের উত্তর তীরবর্তী এক প্রাচীন গ্রাম। এককালে এখানে নদী বন্দর ছিল। এই বন্দরের মাধ্যমে দূরবর্তী গ্রাম-গঞ্জের সঙ্গে বেশ জমকালো ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। আমদানি-রফতানির সম্পদগুলি ছিল মূলত কাঁসা-পিতলের পাত্র, গালার শিল্প সামগ্রী, লৌহজাত দ্রব্য, গাড়ার বস্ত্র প্রভৃতি। এককালে এই এলাকায় প্রচুর ধনী গোয়ালার বসতি ছিল। তাঁদের দুধ, দই, ঘি প্রভৃতি অজয় নদ মারফত বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছে যেত। অজয়ের যে অংশে গোয়ালাদের ঘি ভরা নৌকাগুলি নোঙর করা হত, পরে তার নাম হয়েছিল ঘৃতদহ।
মূল কথা অজয়ের উপর নির্ভর করেই এই ইটণ্ডা গ্রামের বেড়ে ওঠা। অন্তত এমনটাই মনে করেন আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, গ্রামটির গৌরবময় অতীত আছে। প্রায় হাজার বছর আগে ব্রাহ্মণ, চর্মকার, তন্তুবায়, ভট্ট, ময়রা, ছুতোর প্রভৃতি সম্প্রদায় নিয়ে গ্রামটি গড়ে ওঠে। পরে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও বসবাস করতে শুরু করেন। ১৭৮২ সাল নাগাদ রেভারেন্ড জন চিপ বীরভূমে নীল ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। তিনি বোলপুরের কাছে সুরুলে একটি নীলকুঠি নির্মাণ করেন। বীরভূমে, বিশেষ করে অজয় নদের অববাহিকার এক সুবিশাল অঞ্চল জুড়ে নীলের চাষ হতো তখন। পরে জন চিপ ইটণ্ডাতেও একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। ইটণ্ডার বেশ কিছু অভিজাত পরিবার সে সময়ে নীল চাষে অংশ নিয়েছিল।
ইটাণ্ডা মূলত মন্দির গ্রাম। বিভিন্ন সময়ে একাধিক সম্প্রদায় বা ব্যক্তির সহযোগিতায় এই প্রাচীন গ্রামটির সমগ্র অঙ্গ জুড়ে অসংখ্য মন্দির খোদিত হয়েছে। সেগুলির ইতিহাস সম্পর্কে কেউই সঠিক ধারণা দিতে পারে না। লোকমুখে প্রচারিত শ্রুতিকথাতেই কিছুটা আন্দাজ করা যায়। এই সব মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানা লোমহর্ষক অলৌকিক ঘটনা। রথতলা বা চণ্ডীতলার কেশবাঈ এই গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। পুরাণ মতে, সতীর একান্নটি মহাপীঠ থাকলেও বেশ কিছু উপপীঠও আছে। বীরভূমে কসবা (ভ্রংপীঠ) এবং ফুলবেড়ে (দন্তপীঠ)-র পাশাপাশি ইটণ্ডা (কেশপীঠ)-কেও সতীর উপপীঠ রূপে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। কথিত আছে, বৃন্দাবনে দেবীর কেশ পতিত হয়ে কাত্যায়নী মন্দির স্থাপিত হয়। তবে কেশগুচ্ছের কিছু অংশ ইটণ্ডাতেও পতিত হয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে। তাই ইটণ্ডার কেশবাঈ মন্দির সতীর উপপীঠ নামে পরিচিত। এককালে দেবী কেশবাঈ ইটণ্ডা-সহ পার্শ্ববর্তী গ্রামের ‘শাসনদেবী’ রূপেও বেশ সম্মানিতা ছিলেন।
বর্তমানে এই মন্দির নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে। এক বিশাল পাকুড় গাছ মন্দিরটিকে গ্রাস করে চলেছে বছরের পর বছর। পোড়ামাটির ছোট ছোট ইট দিয়ে নির্মিত এই মন্দিরের গর্ভগৃহে অষ্টধাতুর মূর্তি ছিল। ষোড়শ শতকের দিকে কালাপাহাড়ের আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূর্তিটি। তবে কয়েক বছর আগে পর্যন্ত সেটি মন্দিরেই শোভা পেতো। পরে চুরি হয়ে যায়। এককালে এই ইটণ্ডা গ্রামের জমিদার ছিল সিংহ পরিবার। তাঁরাই কেশবাঈ মন্দির সংলগ্ন চণ্ডীতলায় এক অভিনব রথযাত্রার সূচনা করেন। নির্মাণ করেন একটি জগন্নাথ মন্দিরও। জমিদারি প্রথা চলে যাওয়ার পরে সিংহ পরিবারের বিশাল জমিদার বাড়ির এখন ভগ্নদশা। জগন্নাথ মন্দিরটিও ধ্বংসের মুখে। কিন্তু নিয়ম মেনে আজও রথযাত্রা হয় প্রতি বছর।
তবে গ্রামটির যা কিছু খ্যাতি, তা জোড়বাংলা কালী মন্দিরের জন্যে। মন্দিরটি স্থানীয়দের কাছে হাড়কাটা বা হড়কা কালী মন্দির নামে পরিচিত। ষোড়শ শতকের পরের মন্দিরগুলি গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের কথা ভেবে তাঁদের কুঁড়ে ঘরের আদলে চালা প্রকৃতির তৈরি করা হত। দু’টি চালা প্রকৃতির মন্দিরকে যখন পাশাপাশি রেখে জোড়ায় নির্মাণ করা হয়, তখন তাকে জোড়বাংলা মন্দির বলে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, ইটণ্ডার বাজারপাড়ার এই জোড়বাংলা মন্দিরটি বীরভূমে মাত্র একটি-ই আছে। তাই এর গুরুত্ব অন্য প্রাচীন মন্দিরগুলির তুলনায় কোনও অংশে কম নয়। ইটণ্ডার এই মন্দিরের মূল আকর্ষণ সমস্ত শরীর জুড়ে ফুটিয়ে তোলা চোখ ধাঁধানো পোড়ামাটির টেরাকোটা শিল্প। শিল্পীর নিপুণ হাতে নিখুঁত ভাবে পুরাণের বিভিন্ন চিত্রপট তুলে ধরা হয়েছে। তবে মন্দিরটির নির্মাণকাল নিয়ে বিতর্ক আছে। এক মতে, প্রায় দু’শো বছর আগে এই এলাকায় একদল ‘রুহিদাস’ সম্প্রদায় বাস করত। তাঁদের জীবিকা ছিল মরা পশুর হাড় কেটে চিরুনি, গলার মালা প্রভৃতি অলঙ্কার তৈরি করা। স্থানীয় ভাষায় তাঁদের হাড়কাটা রুহিদাস বলা হতো। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে তাঁরাই সোনামুখীর নির্মাণ শিল্পীদের দিয়ে চুনসুড়কির গাঁথনিতে এই অপূর্ব সুন্দর কালী মন্দিরটি নির্মাণ করেন। অন্য সূত্র বলছে, ১৮৪৪ সালের দিকে মন্দিরটি তৈরি করেছিল দুঃসাহসী হাড়কাটা ডাকাতদল। দীর্ঘদিনের অবহেলায় এই মন্দিরটিও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। সমস্ত শরীর জুড়ে ফুঁড়ে বেরিয়েছিল বট-অশ্বত্থ। নষ্ট হচ্ছিল প্রাচীন টেরাকোটা শিল্পের চিত্রপট। পরে রাজ্য সরকার মন্দিরের সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়। ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ’ ১৯৯৭ থেকে ২০১১ সালের জুলাই পর্যন্ত সংস্কার করে মন্দিরটিকে ধ্বংসের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা করে।
গ্রামের সাধু ও পাইন পরিবার বিভিন্ন সময়ে অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করেছিল। তার মধ্যে একটি পাইন পরিবারের রেখা দেউল প্রকৃতির শিব মন্দির। ১৮১৫ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিল গদাধর পাইন। মন্দিরটির অলঙ্কার হিসাবে পোড়ামাটির টেরাকোটা শিল্পের ফলক ব্যবহার করা হয়েছিল। এই মন্দিরের পাশেই ভগ্নপ্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সাধু পরিবারের একটি পঞ্চরত্ন প্রকৃতির শিব মন্দির। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের কিছুটা উপরে বসানো একটি কালো ফলকে বাংলায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে ১৭৫০ শকাব্দ অর্থাৎ ১৮১৮ সালে রাসানন্দ সাধু এটি নির্মাণ করেছিলেন। এখানেও মন্দিরটির আপাদমস্তক পোড়ামাটির টেরাকোটা শিল্পের অপূর্ব অলঙ্কারে অঙ্কিত। সংস্কারের অভাবে এই টেরাকোটা শিল্পের অনেক চিত্রই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি চিত্রগুলি নষ্ট হওয়ার পথে।
সাধু পরিবারের আর একটি অপূর্ব কীর্তি দালান প্রকৃতির দ্বিতল চাঁদনী আকারের শ্রীধর মন্দির। হঠাৎ দেখলে মনে হবে প্রাচীন কোনও রাজবাড়ির সম্মুখভাগ। ইটণ্ডায় যে এককালে বিষ্ণু দেবতার আরাধনা হতো, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইউরোপিয়ান শিল্পরীতির সংমিশ্রণে তৈরি এই মন্দির। আজও সাধু পরিবারের বংশধর এই মন্দিরের দেখভাল করে চলেছেন। তবে সংস্কার করার সামর্থ্য না থাকায় চুনসুড়কিতে নির্মিত মন্দিরটির জায়গায় জায়গায় ক্ষয় ধরেছে।
এ ছাড়া আরও অনেকগুলি মন্দির গ্রামের নানা প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে স্থাপিত হয়েছিল। যেগুলির বেশিরভাগই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। মন্দিরগুলির প্রাচীনত্বের ইতিহাস জানা এখন প্রায় অসম্ভব। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের বহিরাক্রমণ এই প্রাচীন স্থাপত্যগুলির ধ্বংসের অন্যতম কারণ হলেও মানুষের উদাসীনতাকেও সমানভাবে দায়ী করা যায়। এগুলি ধ্বংস হওয়া মানে বাঙালির ইতিহাসের একটা অধ্যায় পুরোপুরি মুছে যাওয়া।
(লেখক সাহিত্যকর্মী ও মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy