Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

জরায়ুহীন মেয়েদের ‘সমৃদ্ধ’ দেশ

মহারাষ্ট্রে এই সব জেলার হাজার হাজার পুরুষ মহিলা সপরিবারে আখের চাষের সঙ্গে জড়িত। এঁরা দরিদ্র, নিরক্ষর, অসহায়। বছরের ছ’মাস এঁদের নিজের গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে যেতে হয় আখ কাটতে। সেখানে তাঁরা কন্ট্রাক্টরের অধীনে কাজ করেন। কাজ বন্ধ করলেই জরিমানা।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

গ্রামে দেখুন খুঁজে, জরায়ু আছে, এমন মহিলা প্রায় পাবেন না।” বলছিলেন হাজিপুর গ্রামের মানদা উগালে। শুধু হাজিপুর নয়, মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন পরিচিত ‘জরায়ুশূন্য অঞ্চল’ বলে। কথাটা শুনতে অদ্ভুত, কিন্তু একেবারে বাস্তব। গত তিন বছর ধরে এই রাজ্যের বিদ, ওসমানাবাদ, সাংলি, সোলাপুর ইত্যাদি জেলায় গ্রামের পর গ্রামে জরায়ুহীন নারীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এই অঘটনের পিছনে সুনির্দিষ্ট কারণটি হল— আখের চাষ।

মহারাষ্ট্রে এই সব জেলার হাজার হাজার পুরুষ মহিলা সপরিবারে আখের চাষের সঙ্গে জড়িত। এঁরা দরিদ্র, নিরক্ষর, অসহায়। বছরের ছ’মাস এঁদের নিজের গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে যেতে হয় আখ কাটতে। সেখানে তাঁরা কন্ট্রাক্টরের অধীনে কাজ করেন। কাজ বন্ধ করলেই জরিমানা। স্বামী ও স্ত্রীকে একটিই ইউনিট হিসাবে ধরা হয়। কন্ট্রাক্টর যে ভাবে খুশি নির্যাতন করে এই আখ-শ্রমিকদের। মেয়েদের উপর বারংবার শারীরিক অত্যাচার চলে। প্রতিবাদের উপায় থাকে না। আইন, শাসন, বিচার এ দেশে দুঃখী মানুষের দরজা পর্যন্ত প্রায়শই পৌঁছতে পারে না। শ্রমিকরা যে তাঁবু বা পর্ণকুটিরে আশ্রয় নেন তা পশুর বাসেরও অযোগ্য। শৌচাগারের ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থায় ঋতুস্রাব মেয়েদের নারকীয় যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দেয়। তার উপর কাজ কামাই করলেই মোটা অর্থের ‘গুনাগার’।

কাজেই অত্যন্ত স্বাভাবিক এই শারীরিক প্রক্রিয়াটিকেই থামিয়ে দেন মহিলারা, চিরতরে। সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকেন স্থানীয় লোভী ডাক্তাররা। স্ত্রীরোগের জন্য তাঁদের কাছে গেলেই তাঁরা শল্যচিকিৎসার টোপ ফেলেন। ‘হিস্টেরেকটমি’ করা হয়। এতে যে শরীরের ক্ষতিও হতে পারে, সে আর ক’জন বোঝেন? কুড়িতেই যে মেয়ে দুই সন্তানের জননী, কিন্তু আখ কাটা ছাড়া যার রোজগারের রাস্তা নেই, ঋতুস্রাব বন্ধ করার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই ভাবে গ্রামের পর গ্রামে জরায়ু-শূন্য হয়ে যান নারীরা। কুড়ি থেকে চল্লিশ, যে কোনও বয়সের হতে পারেন তাঁরা। বেশির ভাগই অপারেশনের পর পিঠে, মাথায়, হাঁটুতে যন্ত্রণার শিকার হন। মাথা ঝিমঝিম করে। তাতে কী? আখ কাটা তো বন্ধ রাখতে হয় না?

ভারতে ঋতুমতী মেয়েদের হেনস্থার শেষ নেই এমনিতেই। তাঁরা মন্দিরে ঢুকলে দেবতা রুষ্ট হন, পুজো করলে পরিবার অপবিত্র হয়, রান্নাঘরে প্রবেশ করলে পাপ অবধারিত। যত্নের বদলে এই সময় অপমানে অযত্নে তাঁদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেওয়াই সমাজ ও পরিবারের ‘কর্তব্য’-এর মধ্যে পড়ে। কিন্তু তার প্রভাব যে এই ভয়ঙ্কর প্রবণতার দিকে মানুষকে নিয়ে যেতে পারে, ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র বিজ্ঞানচেতনা যে চাঁদে পাড়ি দেওয়ার সন্ধিক্ষণে নারীর জরায়ু কেটে নেয়, তা সত্যি আগে ভাবা যায়নি। বিদ জেলার এক সমাজকর্মী জানিয়েছেন, গত তিন বছরে খাতায় কলমে সেখানে জরায়ু বাদ গিয়েছে চার হাজার ছ’শো পাঁচ জনের। খাতার বাইরের হিসেব অন্য রকম।

এই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষপীড়িত অনেক গ্রাম। গ্রামগুলির প্রায় আশি শতাংশ মানুষই প্রতি বছর আখ কাটতে গিয়ে অন্য অঞ্চলে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত কাটিয়ে আসেন। এঁদের মধ্যে যত মহিলা, তাঁদের অর্ধেকের বেশি হিস্টেরেকটমির শিকার। এটা একটা অলিখিত নিয়মই হয়ে গিয়েছে। এক টন আখ কাটলে তাঁরা পান কমবেশি আড়াইশো টাকা। দিনে তিন চার টন কাটলে তবেই তাঁরা তিনশো টনের মতো আখ কাটতে পারেন। এই আয়ে বাকি ছ’মাস তাঁদের দিন-গুজরান করতে হয়। ঋতুস্রাবজনিত কারণে এক দিন কামাই মানে পাঁচশো টাকা ক্ষতিপূরণ। এই ক্ষতি স্বীকার করার চাইতে জরায়ু দিয়ে দেওয়া ভাল। আখ-শ্রমিক সত্যভামা বলছিলেন, “মুকাদামরা (কন্ট্রাক্টার) এখন সোজা বলেই দিচ্ছে যে জরায়ু বাদ দেওয়া মেয়েদেরই দলে নেবে।”

গত কয়েক বছরে এ দেশে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার কয়েক শতাংশ বেড়েছে, যদিও তার মান এবং তার ব্যবহার নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। ‘মিনিস্ট্রি অব হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার’ বয়ঃসন্ধি কালে মেয়েদের স্বাস্থ্য, ঋতুস্রাবজনিত সচেতনতা, বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ ইত্যাদির খাতে তাদের বাজেট কিছুটা বাড়িয়েছে। দুয়েকটি রাজ্যে ‘পিরিয়ড লিভ’-এর রব উঠেছে। কয়েকটি সরকারি কমিটি, সচেতনতা অভিযান ইত্যাদিও হয়েছে। কেরলের স্কুলে বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত সাড়া ফেলেছে। ‘প্যাডম্যান’-এর মতো ছবি লোকে মাল্টিপ্লেক্সে টিকিট কেটে দেখতে গিয়েছেন। তা সত্ত্বেও দেশে উননব্বই শতাংশ মহিলাই এখনও ঋতুস্রাবের মোকাবিলা করেন পুরনো, অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে। আর, মহারাষ্ট্রের আখশ্রমিক মহিলাদের অবস্থা এতটাই নারকীয় যে এই সব আলোচনা, বাজেট, সচেতনতার গল্প ফুৎকারে উড়ে যায়।

এক জন শ্রমিক রমণী, যাঁর বয়স এখনও পঁচিশ পেরোয়নি, ঋতুস্রাবের দরুন তিনি এক দিন কাজ করতে না পারলে তাঁর পাঁচশো টাকা জরিমানা? আর সেই ভয়ে তিনি নিজের জরায়ু বিসর্জন দেবেন, কারণ সারা বছর খেয়েপরে বাঁচার অন্য উপায় নেই? ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘সমৃদ্ধ ভারত’ স্লোগান দিয়ে তা হলে আমরা সত্যিই ‘প্রগতি’র পথে চলেছি!

অন্য বিষয়গুলি:

Work Women Sugar Cane Contractor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy