বন্যায় কেরলে ভয়াবহ পরিস্থিতি। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ মানুষের ঠাঁই হইয়াছে ত্রাণ শিবিরে। শুধু এই পরিসংখ্যানটুকু হইতেই কেরলের বন্যার ভয়াবহতা বুঝিয়া লওয়া সম্ভব। মুখ্যমন্ত্রী জানাইয়াছেন, এখনও অবধি যে হিসাব কষা হইয়াছে, তাহাতে রাজ্যের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৯,৫০০ কোটি টাকা। অঙ্কটি আরও বাড়িবে বলিয়াই আশঙ্কা, কারণ এখনও জলমগ্ন অঞ্চলগুলিতে বিশেষত ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতির হিসাব এখনও মিলে নাই। কিন্তু, সম্পত্তির ক্ষতিই শেষ কথা নহে। যে বিপুল বন্যায় রাজ্যের ১৪টি জেলার মধ্যে ১৩টিই ভাসিয়া যায়, তাহাতে মানুষের বিপন্নতা সব হিসাবের বাহিরে। যুদ্ধকালীন তৎপরতা ব্যতীত ত্রাণকার্যে সফল হওয়া অসম্ভব। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ বলিতেছে, কেরলের প্রশাসন তাহাতে সফল। মুখ্যমন্ত্রী বিদেশ সফর বাতিল করিয়া ত্রাণকার্য তদারক করিতেছেন। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীও তৎপর। এবং, সাধারণ মানুষের ভূমিকা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান আরও বেশি দুর্ভাগ্যজনক বলিয়া প্রতিভাত হইতেছে। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের নিকট ত্রাণবাবদ ২,০০০ কোটি টাকা চাহিয়াছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ দিয়াছিলেন মাত্র ১০০ কোটি টাকা। অটলবিহারী বাজপেয়ীর শেষকৃত্য সারিয়া নরেন্দ্র মোদী আকাশপথে কেরলের বন্যা পরিস্থিতি দেখিলেন এবং তাহার পর আরও ৫০০ কোটি টাকা ত্রাণ ঘোষণা করিলেন। অর্থাৎ, মোট ৬০০ কোটি টাকা। এবং, কেন্দ্র যত দিনে এই টাকা দেওয়ার কথা বলিল, তাহার মধ্যে বহু রাজ্য তাহাদের তরফ হইতে সাহায্য ঘোষণা করিয়াছে, সাধারণ মানুষ টাকা তুলিয়াছেন। কেহ যদি অভিযোগ করে যে কেন্দ্রের এই গয়ংগচ্ছ মনোভাবের পিছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আছে, কেরলের মাটিতে বিজেপি আঁচড় কাটিতে পারে না বলিয়াই তাহার জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করিতেও নরেন্দ্র মোদীদের অনীহা, সেই কথাটি উড়াইয়া দেওয়া সম্ভব হইবে কি? কথাটি সত্য কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে কেন্দ্রীয় সরকারের নিরপেক্ষতা লইয়া এমন গুরুতর প্রশ্ন উঠিতেছে, তাহাই যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। যে কোনও প্রশ্নকেই রাজনৈতিক প্রশ্নে পরিণত করিবার অভ্যাসটি প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসযোগ্যতাকে কী হারে কমাইয়াছে, তিনি ভাবিয়া দেখিতে পারেন।
ভাবিবার আরও অনেক কিছুই আছে। প্রকৃতির সহিত যথেচ্ছাচার করিলে তাহার কোন মূল্য চুকাইতে হয়, আপাতত সেই কথাটি ভাবিলে মঙ্গল। পরিবেশবিদ মাধব গ্যাডগিলের বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলিয়াছেন, কেরলের এই বিপর্যয় বহুলাংশে মনুষ্যসৃষ্ট। বেলাগাম পাথরখাদান, যথেচ্ছ নির্মাণ, পরিকল্পনাহীন শিল্পায়নই এই বিপদ ডাকিয়া আনিয়াছে। নদীর অববাহিকার নিচু অঞ্চলে যে ভঙ্গিতে একের পর এক বাড়ি গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহাতে এই বিপর্যয় কার্যত অনিবার্য ছিল। নদীর স্বাভাবিক গতিপথে নির্মাণ হইলে নদী যে তাহাকে সহে না, এই কথাটি ভারত বোঝে নাই। উত্তরাখণ্ড হইতে কেরল, দেশের সর্বত্র ছবিটি অবিকল। অভিজ্ঞরা বলিতেছেন, উপসাগরীয় অঞ্চলে কর্মরত মালয়ালি জনগোষ্ঠী যে টাকা পাঠান, এই নির্মাণের একটি বড় অংশ সেই টাকাতেই হইয়াছে। মানুষ অর্থ উপার্জন করিতে শিখিয়াছে, সেই অর্থের জোরে পৃথিবীকে দখল করিতে শিখিয়াছে। শিখে নাই শুধু প্রকৃতির ইচ্ছাকে সম্মান করিতে। সেই অসম্মানই বিপদ ডাকিয়া আনে। কেরলে এই বৎসর অস্বাভাবিক বৃষ্টি হইয়াছে, সত্য। তাহার জেরে নদী ফুলিয়া উঠিয়াছে, বাঁধ ছাপাইয়াছে, তাহাও সত্য। বন্যা হইতই। কিন্তু, মানুষ যদি প্রকৃতির নির্দেশ অমান্য না করিত, তবে হয়তো বিপর্যয় এমন মারাত্মক হইয়া উঠিত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy