এখানে এখনও পিচরাস্তা পৌঁছয়নি। তবু গলির বাঁকের বাড়িটার দোতলায় এসি মেশিন দেখে এনকোয়ারির ইচ্ছেটাই মরে গেল। এ বাড়ির মেয়েরই বিয়ে স্থির হয়েছে। পাত্র প্রাথমিক স্কুলের টিচার। এক মাস হল ‘রূপশ্রী’ প্রকল্পের পঁচিশ হাজার টাকার জন্য আবেদন করেছেন পাত্রীর বাবা। ফর্মে লিখেছেন তাঁর বাৎসরিক আয় এক লক্ষ টাকার কম। কী করেন? নীচের তলার এক পানের দোকান দেখিয়ে দিলেন মেয়ের বাবা। পাশেই বাংলাদেশের বর্ডার। নিম্নচাপ নাকি ও দিক থেকেই ঢুকবে, বলছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। তরুণ সহকর্মীকে বললাম, চলো, আর একটা বাড়ি যেতে হবে। মেয়ের বাবা গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। অনেক ভাবে বোঝাতে চাইলেন, রূপশ্রী প্রকল্পের টাকাটা কত প্রয়োজন।
ওঁকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। গ্যাসে ভর্তুকি ছাড়ার অনুরোধ আসতেই আমরা জেহাদ ঘোষণা করেছিলাম। ভর্তুকি পাওয়া যেন গণতন্ত্রে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। রেশন নেব, তার পর কেরোসিন ব্ল্যাক মার্কেটে বেচব। গ্যাস সিলিন্ডার বিয়ের মরসুমে বিক্রি করব দ্বিগুণ দামে। এমন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তদন্ত করতে ইচ্ছেও করে না। কিন্তু এমন ছোট বিষয়ের মাঝেই লুকিয়ে থাকে অনেক বড় কথা, যা আমরা এড়িয়ে যাই।
এ বার কন্যাশ্রী দিবসে মালদহ স্টেশনে বসে আছি দার্জিলিং মেলের অপেক্ষায়। এক অধ্যাপকের স্ত্রী-কে হোয়াটসঅ্যাপে কন্যাশ্রীর ফর্ম পূরণ করে দিলাম। কাল নাকি লাস্ট ডেট। পরম আকুতি, দাদা দেখবেন, টাকাটা যেন ল্যাপ্্স না হয়ে যায়। সে দিনের রূপশ্রী আবেদনকারী মেয়েটির বাবার মুখটা ভেসে উঠল। পার্থক্য এই, অধ্যাপকের মেয়েটি কন্যাশ্রী পাবে, আর সেই দোতলা বাড়ির মালিকের মেয়েটি রূপশ্রী পাবে না। কারণ অনুসন্ধানের পর সরকারি আধিকারিক তাঁর আবেদন বাতিল করেছেন। কিন্তু আগামী বছর যদি রূপশ্রীর ক্ষেত্রেও পরিবারের আয়ের ঊর্ধ্বসীমা উঠে যায়? চালকলের মালিকও অফিসে এসে রূপশ্রীর ফর্ম ভরে দিয়ে যাবেন। সরকারি অফিসার, পুলিশ কর্তারাও আবেদন করবেন। এমন কোনও বাবা-মাকে দেখলাম না যাঁরা এসে বললেন, আমার সামর্থ্য আছে, কন্যাশ্রীর টাকা চাই না।
ফেসবুকে কত অনাচার-বিরোধী বক্তব্য দেখা যায়। কিন্তু ‘সাবসিডি ছাড়ুন, দেশ বাঁচান’, এই পোস্ট একটিও পাইনি। যে অর্থ আমার প্রাপ্য নয়, তাকে গ্রহণ করা যেন অনাচার নয়। জন্মদিনে রক্তদান, বন্যায় ত্রাণ বিতরণের ছবি কতই পোস্ট হয়। শুধু ‘এই যে ভর্তুকি ছাড়লাম’ এমন নিজস্বী আজও দেখলাম না। এক দিন এক ভদ্রলোক অফিস ঘরে ঢুকে বললেন, তিনি ‘এস সি’ হতে চান। পরিচয় জানতে চাইলে সটান উত্তর, ‘জেনারেল কাস্ট’। বললেন, ‘হাইস্কুলে চাকরি করি। এ বারই নেট দেওয়ার বয়স পেরিয়ে যাবে। স্যর প্লিজ় একটু দেখুন না।’ সরকারি সুবিধে পাওয়ার নেশায় আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে এক পলক সময় লাগে। গত বার বন্যায় ‘বাড়িতে কাজের মাসি আসেনি’ বলে রিলিফের খিচুড়ি বাড়ি নিয়ে যেতেও বাধেনি এক অধ্যাপকের।
অথচ আমরাই বাজারে গেলে শাকের আঁটি নিয়ে কোনায় বসে থাকা মাসিকে দু’আঁটি বেশি দিতে বলি। রিকশা চালককে বলি, পয়সা সস্তা না কি? দোকানে দাম করতে করতে কাজুর টুকরো মুখে হামেশাই চালান করি। শ্যাম্পুর স্যাশেতেও ছাড় পাওয়ার আশায় একটি বিশেষ দিনে সুপার মার্কেটে যাই। টাকার দাম বুঝি না, তা তো নয়। সরকারি টাকার দাম দিই না কেবল। সরকারি আধিকারিক দোকানের ডিজিটাল মেশিনে পুরনো কাগজ মাপছেন দেখেছি— কাগজওয়ালা বড় চুরি করে।
দেশ বাঁচাতে কারা প্রাণ দিয়েছেন, সেই তালিকায় বাঙালির নাম যেন ফুরোতে চায় না। কিন্তু দেশের টাকা বাঁচাতে কারা এগিয়ে এসেছেন, সেই তালিকায় বাঙালি সবার শেষে। অন্তত রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি ছাড়ার হিসেব তো তেমনই বলছে। দিল্লিতে সতেরো শতাংশ লোক ভর্তুকি ছেড়েছেন, মহারাষ্ট্রে ছয় শতাংশ, উত্তরপ্রদেশে চার শতাংশ। মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুরের মতো দরিদ্র রাজ্যেও দশ শতাংশের বেশি লোক ভর্তুকি ছেড়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে? দুই শতাংশ।
ভর্তুকির টাকাকে মধ্যবিত্ত মনে করে সাশ্রয়। সরকার দিলে রোজগারের টাকা অন্য কাজে খরচ করা যাবে। সাশ্রয় তো ভাল। গলদ এখানেই। সরকারি সহায়তা না পেলে যে পরিবার বাড়িতে গ্যাস আনতে পারবে না, কেরোসিনের কুপি জ্বালাতে পারবে না, সন্তানের পড়ার খরচ জোগাতে পারবে না, ভর্তুকি-অনুদান শুধু তার জন্য। ভর্তুকি সাশ্রয়ের জন্য নয়, সঙ্কুলানের জন্য। যার সঙ্গতি রয়েছে, তার পক্ষে নেওয়া অপরাধ। চুরি-ডাকাতির শামিল।
অথচ আমরা নিত্য নালিশ করি, সরকার বঞ্চনা করছে। আরও অনেক সুবিধে, আরও বেশি সুযোগ পাওয়া উচিত ছিল। কার কাছে অভিযোগ পেশ করা যায়, তার খোঁজ চলছে শুধু। নাগরিকের অধিকার নিশ্চয়ই আছে, কর্তব্য কি কিছুই নেই?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy