নাগরিক যাহাতে সুবিচার পান, তাহা নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যেই সংবাদ প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম। কিন্তু সংবাদমাধ্যমই বিচারক হইয়া উঠিতে পারে না; ‘বাক্স্বাধীনতা’-র দোহাই দিয়া বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্যও প্রচার করিতে পারে না। পর পর তিনটি ঘটনায় তাহা মনে করাইতে হইল আদালতকে। দেশের মুসলমানদের সামগ্রিক ভাবে ‘অপরাধী’ প্রতিপন্ন করিবার জন্য একটি চ্যানেল তিরস্কৃত হইল সুপ্রিম কোর্টে। ভারতের সিভিল সার্ভিসে মুসলমান ছাত্ররা ‘অনুপ্রবেশ’ করিতে চাহেন, এমন বিপজ্জনক বক্তব্যের জন্য অনুষ্ঠানটির সম্প্রচার স্থগিত করিয়াছে শীর্ষ আদালত। অপর দুইটি ক্ষেত্রে অভিযোগ ‘মিডিয়া আদালত’ বসাইবার। কিছু টেলিভিশন চ্যানেল একাধারে অভিযোগ তুলিতেছে, ‘তদন্ত’ করিতেছে এবং ‘রায়’-ও ঘোষণা করিতেছে। মুম্বই পুলিশের আট প্রাক্তন কর্তা হাইকোর্টে আবেদন করিলেন, সুশান্ত সিংহ রাজপুতের অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলার ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বন্ধ হউক। টেলিভিশনে যে ভাবে মুম্বই পুলিশের প্রতি নানা অভিযোগ আনিয়া বিষোদ্গার চলিতেছে, তাহা পুলিশের ভাবমূর্তিকে আঘাত করিতেছে। অপর দিকে দিল্লি হাইকোর্ট সুনন্দা পুষ্করের অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলায় একটি সর্বভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলকে তিরস্কার করিয়াছে। কংগ্রেস নেতা শশী তারুরের বিরুদ্ধে তাঁহার স্ত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিবার অভিযোগ করিয়াছে পুলিশ। কিন্তু ওই চ্যানেলটি ক্রমাগত সুনন্দার মৃত্যুকে ‘হত্যা’ বলিয়া অভিহিত করিতেছে। দিল্লি হাইকোর্ট বলিয়াছে, যে কোনও মামলার তদন্ত ও বিচার আইন অনুসারে আদালতেই করিতে হইবে। সংবাদমাধ্যম সাক্ষ্য খুঁজিয়া নিজের মতো বিচার করিতে পারে না। আদালতের তিরস্কার: ফৌজদারি আইন পড়িয়া তবেই সাংবাদিকতা করা হউক।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যম তথা সাংবাদিকের স্বাধীনতার গুরুত্ব লইয়া আজ আর নূতন করিয়া বলিবার কিছু নাই। বিশেষত, ক্ষমতাবানরা যখন গণতন্ত্রের স্বাভাবিক শর্তগুলি লঙ্ঘন করিয়া স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যগ্র হয়, তখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য হইয়া দাঁড়ায়। ভারতে গত কয়েক বছরে সেই প্রয়োজন অতিমাত্রায় প্রকট। দক্ষিণপন্থী অতিজাতীয়তাবাদীদের কুক্ষিগত অন্য অনেক দেশের পাশাপাশি ভারতেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণে অপচেষ্টা উত্তরোত্তর বাড়িতেছে, বাড়িতেছে স্বাধীনচেতা সাংবাদিকদের লাঞ্ছনা। ভারতে রাষ্ট্র তাঁহাদের উপর নিয়ত রাষ্ট্রদ্রোহিতা, হিংসায় উসকানি, নেতার সম্মানহানির মামলা ঠুকিতেছে।
কিন্তু এই বিপদের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের মর্যাদা ও ভূমিকা অন্য একটি কারণেও বিপন্ন হইতেছে, যাহাকে বলা চলে অন্তর্ঘাত। বলদর্পী শাসক যদি ছলে বলে কৌশলে সংবাদমাধ্যমের একাংশের ভিতরে আপন প্রভাব ও প্রভুত্ব কায়েম করিতে তৎপর হয়, এবং সংবাদমাধ্যমও সেই শাসককে তুষ্ট করিতে উঠিয়া-পড়িয়া লাগে, তাহার পরিণাম ভয়াবহ হইতে পারে। কত দূর সংবাদমাধ্যমের অধিকার ও এক্তিয়ার, এই বিবেচনা না থাকিলে সমগ্র সমাজেরই বিরাট বিপদ ঘনাইতে পারে। স্পষ্টতই, ভারতের সংবাদমাধ্যম আজ বিচারবিভাগের নিকট সেই বিপদের সতর্কীকরণ শুনিতেছে, সেই মর্মেই তিরস্কৃত হইতেছে। সাংবাদিকের যেমন স্বাধীনতা আছে, তেমনই বিপুল দায়বদ্ধতা আছে— সংবিধানের প্রতি, দেশের প্রতি, নাগরিকের প্রতি দায়বদ্ধতা। সংবাদমাধ্যম বাক্স্বাধীনতার অপব্যবহার করিলে, আইন তাহাকে সংযত করিবে। প্রসঙ্গত ভারতের আইন টেলিভিশন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তুলনায় শিথিল, অনলাইন পরিসরে শিথিলতর। এই ফাঁক গলিয়াই অনেকে স্বার্থসিদ্ধির খেলা বা বিদ্বেষ-বেসাতিতে নামিয়াছেন। প্রবণতাটির মূলোচ্ছেদ কনা করিলে সংবাদমাধ্যমের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হইবে, যে ক্ষতি পূরণ করা কঠিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy