Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Cattle smuggling

মাটির গভীরে ডিল, লেজের মোচড়ে টিটি

ছোলার ডাল দশ কেজি, মশলা পাঁচ কেজি, বাঁচার লাঠি ১২টি। পাচারকারীদের ‘কোডেড’ তালিকায় চোখ রাখলেন গৌরব বিশ্বাসকাজ হবে ইশারায়। লেখা হবে সঙ্কেতে। এ দিক থেকে গরু যাবে। গাঁজা যাবে। আর যাবে কাশির সিরাপ।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:৩১
Share: Save:

বিশ্বাসে মিলায় গরু, সন্দেহ বহু দূর!

কাজ হবে ইশারায়। লেখা হবে সঙ্কেতে। এ দিক থেকে গরু যাবে। গাঁজা যাবে। আর যাবে কাশির সিরাপ। ও দিক থেকে আসবে চিরকুট, টাকা এবং সোনা। কিন্তু চোরাপাচারেও ইমান ও বিশ্বাসের ভারী কদর। এই দু’টি না থাকলে কারবার চলে না।

গরু নিয়ে সারা দেশ জুড়ে হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার। কেউ গরুর গলায় মালা দিতে গিয়ে কসরত করছেন। কেউ আবার ভক্তিভরে প্রণাম করছেন। চর্চায় ব্যস্ত নিন্দুকেরাও, ‘‘আচ্ছা, গরু যদি মা হয়, তা হলে মোষ, হাতি, রামছাগল, এমনকি মুরগিও তো আমাদের আত্মীয়! মানে, ওরা কেউ পিসি, মাসি, সেজ জ্যেঠা, রাঙা মামা!’’ গোবর নিয়ে এতকাল নানা চর্চা হয়েছে। এখন গরুর বাতকর্ম নিয়েও উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীদের একাংশ। নেতাদের সৌজন্যে প্রায়দিনই গরুর ছবিও দেখা যাচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। কবে হয়তো দেখা যাবে, গরু নিজেই বিবৃতি দেবে বলে বৈঠক ডেকেছে।

তবে এ সব নিয়ে একেবারেই ভাবিত নয় ওরা। ওরা মানে ওসমান, জাব্বার, ফড়িং, মুক্তেশরা। ওরা জানে, আর পাঁচটা ব্যবসার মতো এ-ও ব্যবসা বই আর তো কিছু নয়। ওদের কথায়, ‘‘এত ভাবলে কি আর চলে কত্তা! ওই যে দেখছেন, নদীর বাঁকটা, ওইটুকু পৌঁছে দিতে পারলেই কাজ শেষ। তবে এই পুলিশ ও বিএসএফও একেবারে ছিনে জোঁকের মতো লেগে আছে। ব্যবসা চালানো বড় কঠিন হয়ে পড়ছে।’’

যদিও পাচারকারীদের পাচারকারী শব্দটায় ঘোর আপত্তি। ওরা বলে, পাচারকারী আবার কী, বলুন ব্যবসায়ী। (সীমান্তের বহু লোককেই বলতে শোনা যায়, ‘বর্ডারে ব্যবসা করি’) জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘হতচ্ছাড়াদের এমনি তেমন বিদ্যে নেই। কিন্তু বুদ্ধি ধরে সাঙ্ঘাতিক। এই বুদ্ধি যদি ওরা ভাল কাজে লাগাত তা হলে সীমান্তের চেহারাটাই বদলে যেত।’’ বিএসএফ ও পুলিশের দাবি, পাচার আগের চেয়ে অনেক কমেছে। কিন্তু একেবারে বন্ধও হয়নি। পুলিশ ও বিএসএফ সতর্ক থাকে। তক্কে তক্কে থাকে পাচারকারীরাও। ফলে পাচার চলে তার নিজের নিয়মে। নতুন ছন্দে, নতুন কোডে! সেই কোড বা সঙ্কেত ধরতে না পারলে খুব মন দিয়ে পাচারকারীদের ফোনের কথোপকথন শুনলেও কিস্যু বোঝা যাবে না।

যেমন ফোনে কেউ এক জন বলছে, ‘‘ডিল থাকবে আরডিতে। বিহানের আগেই পেয়ে যাবেন। টাকা বুঝে নেব টিটির কাছে।’’ বিহান মানে সকালবেলা। সীমান্তের লোক হলে বুঝতে পারবেন, ডিল মানে একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের নিষিদ্ধ কাশির সিরাপের কথা হচ্ছে। কিন্তু আরডি কী? না, এর সঙ্গে সঙ্গীত কিংবা পঞ্চমবাবুর কোনও সম্পর্ক নেই। গর্তকে ওরা বলে আরডি। টিটি-র সঙ্গে ট্রেনেরও কোনও যোগ নেই। কারণ, এ টিটি সে টিটি নয়। টিটি হল ‘টাকা ট্রান্সফার’। এ দেশের গরু ও দেশে যাবে। ও দেশ থেকে আসবে একটা আটপৌরে কাগজ। সেই কাগজ যাবে নির্দিষ্ট লোকের কাছে। সেখানে সে কাগজ দেখালে মিলবে টাকা। কোনও ‘বাউন্স’ নেই। লিঙ্ক ফেলিওরের ব্যামো নেই। শুধু আছে বিশ্বাস।

এ যদি ফোনের কথা হয়, তা হলে লেখার গেরো আরও জটিল। মাঝেমধ্যেই পুলিশ কিংবা বিএসএফের ফাঁদে ‘পাখি’ পড়ে। হাতে আসে ভাঁজ করে রাখা মলিন কাগজ। সে কাগজ যেন তাদের কাছে জানের থেকেও প্রিয়। হাতছাড়া হলেই সব শেষ। কিন্তু পুলিশে ছুঁলে কি আর রক্ষে আছে! অতএব, চমকে-ধমকে সে কাগজ বেরোয়। অত্যন্ত খারাপ হস্তাক্ষরে যা লেখা থাকে তার মানে উদ্ধার করতে পুলিশেরও কালঘাম ছুটে যায়। মুর্শিদাবাদের সীমান্ত ঘেঁষা রানিনগর থানার এক পুলিশ আধিকারিক বলছেন, ‘‘আর বলবেন না মশাই। কাগজে লেখা আছে বোল্ডার কুড়িটা, পেপসি তিরিশটা...! বহু কষ্টে সে সবের মানে জানা গিয়েছে। বোল্ডার হল মোষ। আর পেপসি মানে গরু। এ সব গরু-মোষ বাংলাদেশে কার কাছে যাবে তা-ও লেখা থাকে সেই চিরকুটে। সেখানেও জট। কারও নাম লেখা নেই। আঁকা আছে কোকিল, ফড়িং কিংবা জবা ফুলের ছবি। কোকিল হচ্ছে পাচারকারীদের এক জন যে কি না ভাল গান গায়। জবা মানে জাব্বার শেখ। আর ফড়িং মানে রোগাপাতলা কেউ যার আসল নাম হয়তো ফরজ বা বিমল।’’

বছর কয়েক আগে জলঙ্গির থানার পুলিশের হাতেও এসেছিল এমনই আর এক কাগজ—‘ছোলার ডাল, দশ কেজি। মুসুর ডাল, দশ কেজি। মশলা পাঁচ কেজি। বাঁচার লাঠি ১২টি। বড় টর্চ ১০টি। ছোট টর্চ ২০টি। ব্যাটারি ৫০টি।’ এক ঝলক দেখলে মনে হতেই পারে, বাজার করার ফর্দ। কিন্তু পোড়খাওয়া পুলিশ আধিকারিক বুঝতে পারেন, এ কেস অত সোজা নয়। মুদির দোকানে ছোলা-মুসুরের ডাল না হয় পাওয়া গেল। কিন্তু বাঁচার লাঠি কী? পাকড়াও করা হল যে দোকান থেকে লিস্ট মিলেছিল সেই দোকানদারকে। পুলিশের জেরায় সে জানায়, ডাল মানে ডিল (সেই নিষিদ্ধ কাশির সিরাপ)। ছোলা মানে বড়, মুসুর মানে ছোট বোতল। মশলা হল বোমার মশলা। বাঁচার লাঠি বলা হয় ওয়ান শটারকে। বড় টর্চ পাইপগান, ছোট টর্চ পিস্তল। আর ব্যাটারি? এ বার দোকানদার আমতা আমতা করে বলে, ‘‘ইয়ে, মানে গুলি স্যর। ওতেই তো টর্চ জ্বলে।’’

জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘পাচারকারীদের কোড উদ্ধার করতে ০০৭, মানে বন্ড সাহেবকেও বেগ পেতে হত! পাচারকারীদের থেকে যে সমস্ত ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে তা দেখেও চমকে উঠতে হয়। নম্বরের পরে নম্বর। কিন্তু কোথাও কারও নাম সেভ করা নেই। নম্বর দেখেই ওরা বুঝে নেয় কোনটা কার নম্বর। ব্যাটাদের স্মরণশক্তিটা ভাবুন এক বার!’’ তবে এ সব কোড উদ্ধার হয়ে গেল মানেই যে সব জানা হয়ে গেল এমন নয়। ফের তৈরি হয় নতুন কোড। নতুন পদ্ধতি। গরুর সিজন খারাপ যাচ্ছে, তা হলে গাঁজা। গাঁজাতে সমস্যা হলে কাশির সিরাপ। না হলে অন্য কিছু।

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কিছু না কিছু পাচার চলছেই। গ্রীষ্মকালে ওরা অপেক্ষায় থাকে কালবৈশাখীর। সীমান্তের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় জড়ো করে রাখা হয় গরু। তৈরি থাকে রাখালেরা। তারা রীতিমতো দৌড়ে ওস্তাদ। ধুলোঝড় শুরু হলেই গরুর পিঠে পড়ে পেরেকওয়ালা লাঠি। সাঁ সাঁ করে ছুটতে থাকে গরু ও রাখালের দল। কখনও কখনও গরুর পায়ে পিষ্টও হতে হয়। সে হোক। ওপারে গরুগুলো পৌঁছলেই হাতে আসে কাঁচা টাকা। বর্ষার পাচারে বড় আড়াল পাট। সীমান্তে পাটচাষ হবে কি, হবে না— তা নিয়ে ফি বছর বিএসএফ ও স্থানীয় চাষিদের মধ্যে একটা টানাপড়েন চলে। তার পরেও পাটচাষ একেবারে বন্ধ করা যায়নি। মানুষ সমান ঘন পাটের মধ্যে দিয়ে গরু নিয়ে চলে গেলে দূর থেকে বোঝার কোনও উপায় থাকে না। পরের দিন অবশ্য খেতের চেহারা দেখে চোখ কপালে ওঠে চাষির। কখনও কখনও পাট জমি থেকে না উঠতেই বহু জমির পাট পাচারকারীরা কিনে নেয়। দামও দেয় গড়ে বিঘা প্রতি দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা। সেই পাট জাঁক দেওয়া হয় পদ্মায়। জাঁকে ভাল করে মাটি, খড় দিয়ে কষে বাঁধা হয় একটু ছোট সাইজের গরু। রাতের অন্ধকারে সেই জাঁক দেড় থেকে দু’কিলোমিটার ভাসিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। রানিনগরে গত বছর কলাগাছও বেশ ভাল বিকিয়েছে। ক্রেতা সেই পাচারকারীরাই। বিশেষ পদ্ধতিতে কলার ভেলা তৈরি করা হয়। গরু থাকে জলের নীচে। মুখটুকু জেগে থাকে ভেলার মাঝে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কলাগাছ ভেসে যাচ্ছে। ফলে জলে গেল মানে সবসময় যে ক্ষতি হয়ে গেল, এমনটা ভাবার কারণ নেই। আর শীত হচ্ছে পাচারকারীদের কাছে সেরা সময়। সকালের কুয়াশা দেখেই আন্দাজ করে নিতে হয় রাতে কুয়াশার চাদর কতটা জমাট থাকবে। সেই মতো পদ্মা কিংবা মাথাভাঙার দু’পাড়ে শুরু হয় তুমুল ব্যস্ততা। কথা হয়ে যায় ফোনে ফোনেই। সন্ধ্যার পরে সকলেই তৈরি। অপেক্ষা শুধু ইশারার। কান ও চোখ দুই-ই সজাগ রাখতে হয়। ভাল করে বুঝে নিতে হয় কোনটা আসল শেয়ালের ডাক আর কোনটা দলের লোকের। কুকুরের ডাকটা কি পর পর তিন বার ডেকেই থেমে গেল? না কি এটা কোনও সত্যি কুকুরের ডাক। পাচারের লাইনে কেউ হয়তো দৌড়ে দড় নয়, ভাল দরদামও করতে পারে না। কিন্তু তীক্ষ্ণ শিস দিতে পারে কিংবা অবিকল নকল করতে পারে কুকুর কিংবা শেয়ালের গলা। পাচারকারীদের দলে কদর আছে তাদেরও।

এ বার সকলের চোখ থাকে আকাশের দিকে। কারণ, সব ঠিকঠাক থাকলে আঁধার ফুঁড়ে জোরালো টর্চের আলো পাক খাবে মাথার উপরে। দূরে বিএসএফ ক্যাম্প কুয়াশায় ঝাপসা। ইনসাস, নাইটভিশন ক্যামেরা নিয়ে জওয়ানেরা তৈরি। তৈরি গাছগাছালির সঙ্গে মিশে থাকা ছায়ামূর্তিরাও। তাদের পরনে হাফপ্যান্ট, শরীরের সঙ্গে চাদরটা জাপ্টে বাঁধা। মাথা মাফলারে ঢাকা। এদের সকলের পকেটেই ফোন থাকে। কিন্তু তা ভাইব্রেট মোডে। খুব বিপদ ছাড়া সেই ফোন ব্যবহার করা হয় না। পাছে মোবাইলের আলো কিংবা কথায় সন্দেহ করে বসেন বিএসএফের জওয়ানেরা।

অবশেষে আসে মাহেন্দ্রক্ষণ। টর্চের আলো মাথার উপরে এঁকে দেয় একটা বৃত্ত। এক বার। দু’বার। তিন বার। ব্যস! গরুর পাল নিয়ে শুরু হয় দৌড়। কুয়াশায় ভেজা বালির চর জুড়ে তখন হয় এসপার নয় ওসপার। তবে এক্ষেত্রেও কখনও কখনও লুকোচুরি চলে। যে দিক থেকে টর্চের আলো মহাশূন্যে পাক খেল, গরু নিয়ে দৌড় শুরু হল তার উল্টো দিক দিয়ে। কখনও আবার সীমান্তের এক জায়গায় বোমা ফাটিয়ে দেওয়া হল। বিএসএফ হইহই করে অকুস্থলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পাচারকারীরা গরু নিয়ে দৌড় দিল অন্য দিকে। কাজ শেষ হলে ওরা ঘরে ফেরে। হাতের মুঠোয় চিরকুট। টিটি কারবারির কাছে সেই চিরকুট পৌঁছে দেওয়ার জন্যই তো এত ঝুঁকি নেওয়া, এত দৌড়-ঝাঁপ। সীমান্তে এমন বহু লোকজন আছে, যাঁরা শুধু ঘরে বসে এই টিটি-র কারবারই চালান। আর যদি সেই কাগজ ভুয়ো হয়?

জলঙ্গির এক পাচারকারী ম্লান হাসে, ‘‘ইমান কর্তা, ইমান। এ লাইনে ওতেই সব চলে। তবে ব্যতিক্রম কি হয় না! হয়। তবে খুব কম। তখন সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে হয়।’’ নোট বাতিলের মরসুমে বড়সড় ধাক্কা খেয়েছিল কারবার। তার পরেও হাল ছাড়েনি ওরা। এ পার থেকে গিয়েছে কাশির সিরাপ, গাঁজা কিংবা গরু। ও পার থেকে এসেছে সোনা। এ ছাড়াও আছে ধারের খাতা। সে ধার শোধও হয়ে যায়। কোনও হালখাতা ছাড়াই।

রানিনগর থানার পুলিশের কাছে খবর ছিল, একটি বাড়িতে গরু আছে। পাচার হবে রাতেই। সে বাড়িতে হানা দিল পুলিশ। তবে গরু নয়, মিলেছিল হাজার পাঁচেক কন্ডোম! পুলিশের মেজাজ সপ্তমে, ‘‘এত কন্ডোম কেন রে? এটাকেও তোরা ছাড় দিলি না?’’ উত্তর এসেছিল, ‘‘না স্যর, ওটা ফাউ। ওর মধ্যে কাশির সিরাপের বোতল যায়। জলে ভেজে না। লেবেল ওঠে না।’’ সীমান্ত এলাকায় মাঝেমধ্যেই লোডশেডিং হয়। আলোতে কাজের অসুবিধা হয় কি না! গরু যায়। আলো আসে। চরাচর জুড়ে পড়ে থাকে অজস্র পায়ের ছাপ।

ঋণ: সুজাউদ্দিন বিশ্বাস, শঙ্কর মণ্ডল

অন্য বিষয়গুলি:

Cattle smuggling Border Indo Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy