জঙ্গলের সুরক্ষা এবং বাসিন্দাদের মান উন্নয়নে তৈরি হয়েছিল বন সুরক্ষা কমিটি। ফাইল চিত্র।
প্রায় চল্লিশ বছর হতে চলল বন দফতর, অরণ্যবাসী ও ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নিয়ে যৌথ বন পরিচালনার। এত বছর ধরে ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চারটি বিভাগের কয়েক লক্ষ জঙ্গল সংলগ্ন বাসিন্দা দল-মত নির্বিশেষে লক্ষাধিক হেক্টর বনভূমি সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধির কাজ নীরবে করে চলেছেন। তৈরি হয়েছে জঙ্গলবাসীদের নিয়ে কয়েক হাজার বন সুরক্ষা কমিটি। তারা বন দফতরের সঙ্গে যৌথ ভাবে বন, বনজ সম্পদ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, বনের উন্নয়ন, চারা বাগান তৈরি ও রক্ষা-সহ সব কাজ করতে বন দফতরকে সাহায্য করে চলেছে। বিনিময়ে কমিটির সদস্যরা বিনে পয়সায় বনের শুকনো জ্বালানি, ছাতু (মাশরুম), ফুল, ফল, পাতা ইত্যদি সংগ্রহ করার অধিকার পাচ্ছেন। পাচ্ছেন বনের যে কোনও কাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার অগ্রাধিকার। শুধু তাই নয়, পাঁচ বছর ধরে বনের গাছ রক্ষা করতে পারলে, সরকারি নিয়ম অনুসারে ওই গাছ বন দফতর কাটাই করে ই-টেন্ডারে বিক্রি করার পর তার লভ্যাংশের শতকরা চল্লিশ ভাগ কমিটি পায়। গাছ কাটার পর ডাল-পালারও একটা বড় অংশও কমিটির সদস্যরা পান। সব মিলিয়ে সেই অর্থের পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা। এটাই ছিল যৌথ বন পরিচালনা ব্যবস্থার সরকারি শর্ত। যা সারা বিশ্বের কাছে চর্চার বিষয়, আমাদের গর্ব।
কিন্তু দিন বদলেছে। বিট অফিসারদের অধীনে থাকা জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামের দল-মত নির্বিশেষে মানুষদের নিয়ে গঠিত বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যদের নিয়ে প্রতি বছর উন্নয়নের নানান পরিকল্পনা করা হত। জঙ্গল সংলগ্ন গ্রাম তথা বনের উন্নয়ন। সেই উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি হত তাদের গ্রামে বসেই। তৈরি করতেন দফতরের কিছু নিচুতলার কর্মী। কিন্তু তাঁদের সেই দিন শেষ। বন দফতরের দেড়শো বছরের কাজের প্রথা ভেঙে এখন সব কাজে এসেছে সরকারি নিলাম/ডাক পদ্ধতি অর্থাৎ বেসরকারিকরণ। সব কাজ হবে নিলামে বা দরপত্রে। নিলাম বা দরপত্র ডাকবে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় বন আধিকারিক। ঠিক অন্য দফতরের মতো নিলামে পড়বে দরপত্র, তার পর সবচেয়ে কম টাকায় যে ঠিকাদার কাজ পাবেন তিনিই করবেন কাজ। ঠিকাদারেরা কাজের ধরন অনুযায়ী তাঁদের পছন্দ মতো শ্রমিক কাজে লাগাবেন। কারণ তাঁদের সঠিক কাজ সঠিক সময়ে পরিকল্পনামাফিক শেষ করতে হবে। কাজের সঙ্গে লভ্যাংশের কথা মাথায় রেখেই তাঁরা করবেন। তাঁরা বাধ্য নন তাঁদের কাজ গ্রামের মানুষকে সবিস্তারে জানাতে এবং জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দাদের শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগাতে। তাঁরা দেখবেন মুনাফা আর ঠিক সময়ে কাজ উদ্ধার। তাঁরা তাঁদের নির্দিষ্ট শ্রমিক আর লোকজন দিয়েই কাজ করবেন, এটাই স্বাভাবিক।
আগে কিন্তু এমনটি ছিল না। চার-পাঁচ বছর আগেও বন বিভাগের নিচুতলার কর্মীরা বনের নানান উন্নয়নের কাজ নিজেরা তদারকি করে, নিজেরাই সঠিক জিনিসপত্র কিনে, বন সুরক্ষা কমিটির শ্রমিক নিয়োগ করে করতেন। সে বনের জমিতে চারা বাগান হোক, রাস্তার ধারে বন সৃজন হোক, পুরনো চারা বাগান পরিচর্যা হোক, নতুন চারা তৈরি হোক, পুকুর খোঁড়া হোক, রাস্তা তৈরি হোক, বন্যপ্রাণ রক্ষা হোক বা হাতি তাড়ানো হোক— সব কাজই যৌথ পরিচালন ব্যবস্থার শর্ত অনুসারে হত। যার ফলে গ্রামের দরিদ্র শ্রমিকেরা বন দফতরের কাজে যেমন সঠিক মজুরি পেতেন তেমনই সারা বছরের বেশ কিছু দিন কাজ জুটত। ফলে বন দফতরের নিচুতলার কর্মীদের সঙ্গে জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামের মানুষদের নিয়ে গঠিত বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। তাঁদের এক কথায় যে কোনও বনের সুরক্ষা ও উন্নয়নের কাজে, সভা-সমিতিতে, আলোচনায় গ্রামের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
বর্তমান ঠিকাদারি প্রথায় এত কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নতুন প্রজন্মের বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা। ফল তাঁদের সঙ্গে বন দফতরের দূরত্ব বাড়ছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আবার দেখা যাচ্ছে, যে বিটে কাজ হচ্ছে সেই বিট অফিসার বা রেঞ্জ অফিসারেরাও জানেনই না কাজের পরিকল্পনা, তার খরচের পরিমাণ, কবে-কখন দরপত্র ডাকা হয়েছে এবং কে-ই বা দরপত্র পেলেন। গ্রামের মানুষদের নিয়ে আগের মতো কাজের বিস্তারিত অলোচনা বন সুরক্ষা কমিটির সভায় হয় না। ফলে তারাও অন্ধকারে থাকেন। নিচুতলার কর্মীর মতো বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা জানেন না, কী-কী উন্নয়নমূলক কাজ তাঁদের এলাকায় হবে এবং কারা-কারা সেই কাজ করবেন।
যৌথ বন পরিচালনা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে গিয়ে বর্তমানে বনের সব কাজে ঠিকাদারি প্রথার মধ্য দিয়ে করার ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে যৌথ বন পরিচালনা ব্যবস্থার কফিন তৈরির কাজ হতে শুরু হয়েছে। একজন বনকর্মী হিসেবে বনের জন্য অশনি সংকেত লক্ষ্য করছি। তারই প্রতিফলন ২০১৯ সালে সময় মতো গাছ লাগানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। বেশির ভাগ জায়গায় সময় মতো গাছ লাগানো হয়নি, তার পরিচর্যাও সময় মতো হয়নি। কারণ অর্থ নাকি সময় মতো আসেনি। আসেনি কোনও লিখিত নির্দেশ। ঠিকাদারেরা টাকা পাওয়ার আশ্বাস না পাওয়ায় সময় মতো কোনও কাজ করেননি। তার ফল? বহু জায়গায় চারা বাগান মুখ থুবড়ে পড়েছে। অনেক জায়গায় নিচুতলার কর্মীরা কোয়ার্টারে থাকেন না, থাকলেও ঠিকাদারি পদ্ধতিতে তাঁদের দায়বদ্ধতা নেই বলে এড়িয়ে যান। তাছাড়া বন দফতরের কর্মীও সাংঘাতিক ভাবে কমে গিয়েছে। জঙ্গল টহল, বনজ সম্পদ রক্ষা-সহ সব কাজে কেমন যেন শিথিলতা।
মনে পড়ে, ২০০৮ থেকে ২০১০ জঙ্গল মহল আতঙ্কিত। সরকারি দফতর, বেসরকারি নানান সংস্থার তখন সব কাজ যখন বন্ধ। কেউ যখন উন্নয়নমূলক কোনও কাজ করতে সাহস পাচ্ছিলেন না তখন একমাত্র বন দফতরের কর্মীরা জঙ্গলমহলের আতঙ্কিত মানুষের পাশে থেকেছিলেন। মানুষের জন্য, পরিবেশের জন্য নানান উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন। তাদের কোনও কাজ থেমে থাকেনি। কারণ তখন ঠিকাদারি প্রথা চালু হয়নি। তাঁরাই সরাসরি মানুষদের কাজ দিয়েছেন, উন্নয়নমূলক কাজ করিয়েছেন এবং পাশে থেকেছেন। সেই কারণেই জঙ্গল মহলের মানুষ ওই বিপদেও তাঁদের পাশে ছিলেন। মনে পড়ে, শুধু ঝাড়গ্রাম বন বিভাগে দু’বছরে প্রায় ১৪ কোটির টাকার মতো কাজ ১০০ দিনের প্রকল্পে হয়েছিল। অনেক উন্নয়নের কাজ শুধু বন দফতরই করেছিল। যা অনেকেই জানেন না। বনের সব কাজে ঠিকাদারি পদ্ধতি নতুন প্রজন্মের জঙ্গলবাসীদের সঙ্গে বন দফতরের তথা যৌথ বন পরিচালনা ব্যবস্থার সম্পর্কে দূরত্ব বাড়িয়ে দেবে।
দূরত্বের ফল ভবিষ্যৎই বলবে ।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত বন অধিকারিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy