প্রতিবাদ: কুরবান শা খুনের পরে মিছিল। নিজস্ব চিত্র
দেশের তাবড় রাজনীতিবিদদের অতীত খুঁড়লে দেখা যাবে তাঁদের উত্থান ছাত্র রাজনীতির আঙিনা থেকেই। সেখান থেকে উঠে এসে দেশের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছেন এমন রাজনীতিকের সংখ্যা কম নয়। রাজনীতি সচেতন হতে গেলে ছাত্রাবস্থা থেকেই তা শুরু করার কথা বলে গিয়েছেন অনেক শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা।
কিন্তু সেই পথের অনুসারী হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে আসতে বর্তমান প্রজন্মের অনেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যেই অনীহা দেখা গিয়েছে। এর অন্যতম কারণ হিসাবে তাঁদের দাবি, ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক পথের দিশা দেখাবেন এমন নেতার অভাব। পাশাপাশি কী শাসক, কী বিরোধী দু’দলেরই একাধিক নেতার বিরুদ্ধে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ। যা মানুষের কাছে সেই সব নেতার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। আর একটি কারণ হিসাবে ছাত্রছাত্রীদের মুখে যা শোনা গিয়েছে তা নিঃসন্দেহে চিন্তা জাগায় বইকী। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দলগুলির মধ্যে মতাদর্শের লড়াইয়ে খুনের রাজনীতির আমদানি ছাত্র ছাত্রীদের একাংশকে রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে।
সাম্প্রতিক কালে পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া ও ময়নায় খুন হয়েছেন তৃণমূল তথা শাসক দলের দুই নেতা। যে ঘটনায় খোদ শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের তরফেই অনেকে এই ধরনের রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। এমনকী এই ধরনের রাজনীতি যে তাঁদের একেবারেই অপছন্দ, সে কথাও জানিয়েছেন। পাশাপাশি এমন ঘটনায় ওই সব এলাকায় ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগদানের ক্ষেত্রে অনীহা তৈরি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। অনেকের গলায় শোনা গিয়েছে ছাত্র রাজনীতি করতে এসে জীবন খোয়ানোর আতঙ্কের কথা। যে আতঙ্ক সঞ্চারিত হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের মধ্যেও। পড়াশোনা করতে এসে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক হিংসার শিকার হোক ছেলেমেয়েরা, এমনটা চাইছেন না অধিকাংশ অভিভাবক।
দেশের রাজনীতির মূল স্রোতে ঢোকার আগে ছাত্র রাজনীতি দিয়েই ভাবী নেতাদের হাতেখড়ি হয়ে থাকে। ছাত্র রাজনীতিকে কেন্দ্র করে অন্যান্য রাজ্যে সংঘর্ষের ঘটনার উদাহরণ থাকলেও এ রাজ্যে যে তার মাত্রা অনেক বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাঁশকুড়া ও ময়নায় পর পর দু’টি রাজনৈতিক খুনের ঘটনা সামনে আসায় কলেজ পড়ুয়াদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘প্রভাবশালী নেতারা যদি এই ভাবে খুন হন, তা হলে ছাত্র রাজনীতিতে যাঁরা আছেন তাঁদের নিরাপত্তা কোথায়? খুনের এই রাজনীতির চেয়ে ভাল রাজনীতির সংশ্রব এড়িয়ে চলা।’’
পাঁশকুড়ায় খুন হয়েছেন ৩২ বছর বয়সি কুরবান শা। আর ময়নায় প্রাণ গিয়েছে বসুদেব মণ্ডলের। তৃণমূল দলের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি মাইশোরার সিদ্ধিনাথ মহাবিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্র সংগঠনের শেষ কথা ছিলেন কুরবান। বিরোধী কোনও ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্ব সেখানে নেই। জানা গিয়েছে, কুরবান খুন হওয়ার পর কলেজের বহু ছাত্রছাত্রীই আগামিদিনে কলেজের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগদানের ক্ষেত্রে তাঁদের অসম্মতি জানিয়েছেন সংগঠনের নেতাদের কাছে। যা দেখে কপালে ভাঁজ পড়েছে তৃণমূল ছাত্র সংগঠনের নেতাদের। যার আঁচ পৌঁছেছে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেও। সিদ্ধিনাথ মহাবিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা সৌমেন পাত্র বলেন, ‘‘কুরবানদা খুন হওয়ার পর সংগঠনের বহু সদস্য ফোন করে আগামীদিনে সংগঠনের প্রকাশ্য কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের আপত্তি জানিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি।’’
একই পরিস্থিতি পাঁশকুড়ার বনমালী কলেজেও। কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা অরূপ নায়েকের কথায়, ‘‘দশ বছর পর ফের পাঁশকুড়ায় রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটল। এর প্রভাব আমাদের ছাত্র সংগঠনের মধ্যেও পড়েছে। ছাত্রছাত্রীরা সবাই আতঙ্কিত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।’’
শুধু শাসক দলের ছাত্র সংগঠন নয়, খুনের রাজনীতির আতঙ্ক অন্য দলের ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যেও। বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির সম্পাদক আশিস গুছাইত বলেন, ‘‘কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে। এদের রাজনৈতিক ভ্রান্তনীতির প্রভাব ছাত্র রাজনীতিতেও পড়ছে। কয়েকদিন আগে দু’টি রাজনৈতিক খুনের ঘটনায় ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক মনোবল যে ধাক্কা খেয়েছে তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। তবে আমরা একটা আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করি। তাই যত বাধা আসুক সেগুলি কাটিয়ে ওঠার আত্মবিশ্বাস, সাহস রয়েছে।’’ বিজেপি-র ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সহ-সংযোজক দিব্যেন্দু সামন্ত বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ। জেলায় পরপর নেতা খুনের প্রভাব ছাত্র রাজনীতিতেও পড়েছে। নতুন করে কেউ সক্রিয় ভাবে সংগঠনে আসতে চাইছেন না। এটা যে আতঙ্ক থেকেই তা অস্বীকার করি কী করে।’’ তবে ভিন্ন সুরও শোনা গিয়েছে। ছাত্র সংগঠন ডিএসও-র পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য সুমন্ত সী’র কথায়, ‘‘নীতি আদর্শ নিয়ে যাঁরা ছাত্র রাজনীতি করতে আসেন, এই ধরনের ঘটনা তাঁদের মনে প্রভাব ফেলতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস।’’
ছেলে মেয়েদের ছাত্র রাজনীতিতে আসা নিয়ে অনেক অভিভাবকের যেমন ঘোরতর আপত্তি শোনা গিয়েছে। পাশাপাশি ভিন্ন কথাও বলেছেন অনেকে। বিশ্বনাথ সামন্ত নামে এক অভিভাবক চান ছেলেমেয়েরা রাজনীতি সচেতন হোক। তাঁর কথায়, ‘‘আমি চাই আমার ছেলে বা মেয়ে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হয়ে উঠুক। তবে এড়িয়ে চলুক প্রত্যক্ষ রাজনীতি। তা ছাড়া রাজনীতিতে হিংসার আমদানি বন্ধ করতে নেতাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। তা না হলে দেশকে ভবিষ্যতের নেতা খুঁজতে সঙ্কটে পড়তে হবে।’’ সিদ্ধিনাথ মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র শুভেন্দু নায়েক বলেন, ‘‘এলাকায় পর পর রাজনৈতিক খুন হওয়ায় বাবা-মা কলেজে কোনও সংগঠন না করার জন্য বলেছেন। আমিও চাই কোনও ঝামেলায় না জড়িয়ে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে।’’
ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতি বিমুখ এমন মনোভাব মনে করিয়ে দেয় সেই আপ্ত বাক্য ‘ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ’। পড়াশোনাই ছাত্রছাত্রীদের একমাত্র তপস্যা হওয়া উচিত। তবে একই সঙ্গে তা প্রশ্ন তুলে দেয় ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়েও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy