ছবি: সংগৃহীত
ধর্ম কাহাকে বলে? ধর্ম কী ভাবে স্থির হয়? না, এই মুহূর্তে ইহা কোনও গভীর দার্শনিক প্রশ্ন নহে। দুই হাজার কুড়ি সালের ভারতে ইহা এখন রাষ্ট্রতত্ত্বেরও প্রশ্ন নহে, নিখাদ ব্যবহারিক প্রশ্ন, রাষ্ট্রীয় পরিচালনা পদ্ধতির প্রশ্ন। যে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন সম্প্রতি এই দেশে চালু হইল, তাহার জন্য পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান হইতে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান, পার্সি ধর্মাবলম্বীদের নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় কাগজেকলমে প্রমাণ করিতে হইবে। ওই সব দেশে নির্যাতন হইতে বাঁচিতে তাঁহারা ভারতে আশ্রয় চাহিতেছেন, ইহাও দেখাইতে হইবে। এই আইন লইয়া ইতিমধ্যেই অত্যন্ত মৌলিক সব আপত্তি উঠিয়াছে। ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্বের আবেদন আদৌ ভারতের সংবিধানের সহিত সাযুজ্যপূর্ণ নয়— এমন যুক্তিতে আন্দোলন গোটা দেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু আইনটির সমস্যা কেবল ধর্মীয় বৈষম্যই নহে। সমস্যা আরও মৌলিক। ধর্মপরিচয় বস্তুটিকে কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠা করিতে বলিয়া এই আইনটি ব্যক্তিকে এমন সঙ্কটে ফেলিতেছে যে তাহা হইতে উদ্ধারের আশা ভাবিয়া পাওয়া দুষ্কর। কেননা, ধর্মকে এই ভাবে স্থির নিশ্চিত একক হিসাবে দেখিবার সংস্কৃতি এই উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে নাই, এবং সেই এককের প্রমাণপত্র রাখিবার অভ্যাসটি তো নাই-ই। পিতা হিন্দু নামযুক্ত, তাহাই সন্তান হিন্দু, এই যদি যুক্তি হয়, তাহার বিরুদ্ধে অনেক রকম তর্ক উঠিতে পারে। প্রথমত হিন্দু নাম হইলেই হিন্দু ধর্মযুক্ত, ইহা একটি অতিসরলীকরণ, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভ্রান্তিজনক। দ্বিতীয়ত, হিন্দু পরিবারে জন্ম হইলেই কেহ নিজেকে হিন্দু না ভাবিতে/বলিতে পারেন। তৃতীয়ত, আচারে-বিশ্বাসে ধর্মপালনকারী নহেন, আবার ঘোর নাস্তিকও নহেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নহে, যাঁহারা হিন্দু হিসাবে নিজেদের দাগাইয়া দিতে অস্বস্তি বোধ করেন। চতুর্থত হিন্দু-মুসলিম মিশ্র পরিবারের সন্তানের ধর্ম কী, তাহা একটি অতি গুরুতর প্রশ্ন।
সম্প্রতি দেশের চিত্রজগতের মহাতারকা শাহরুখ খান শেষ প্রশ্নটি তুলিয়াছেন— কেননা তিনি ও তাঁহার হিন্দু স্ত্রী গৌরী তাঁহাদের সন্তানদের এত দিন কোনও ধর্মপরিচয় শিখাইবার প্রয়োজন কিংবা ইচ্ছা বোধ করেন নাই, এবং তাহার দরুন কোনও অসুবিধাতেও পড়েন নাই। ধর্ম কী, এই প্রশ্নের সামনে তাঁহারা সন্তানদের ‘ভারতীয়’ বলিতে শিখানোই সর্বাপেক্ষা যুক্তিযুক্ত মনে করিয়া আসিয়াছেন। আর এক অভিনেতা নাসিরউদ্দিন শাহ বলিয়াছেন যে সত্তর বৎসর কাটাইয়া আজ অকস্মাৎ তিনি মুসলিম পরিচয়ে পরিচিত হইতে শুরু করিলেন, অসীম দুর্ভাগ্য। দুর্ভাগ্য কেবল সিএএ-বহির্ভূত মুসলিম সমাজেরই নহে। সমস্যা সিএএ-অন্তর্ভুক্ত ছয় ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রবল ও গভীর। কী কাগজ তাঁহারা দেখাইবেন নিজেদের ধর্ম প্রমাণের জন্য? কেনই বা দেখাইবেন?
এই সব প্রশ্ন আলঙ্কারিক নহে। ভারতীয় রাষ্ট্র কী ভাবে নিজেকে পুনর্বিবেচনা করিতেছে তাহা জানিবার জন্য অতীব আবশ্যক। হিন্দু ধর্ম ঐতিহ্যগত ভাবেই কখনও নিজেকে নথিভুক্তির নিগড়ে বাঁধে নাই। কাহাকেও দীক্ষিত করিয়া সমাজে গ্রহণ করা, কিংবা ত্যাজ্যমন্ত্রের দ্বারা পরিত্যাগ করিবার ধারা প্রাচীন কাল হইতেই এই সমাজে নাই। হিন্দুসমাজের এই বহমানতা ও নিগড়হীনতা লইয়া বহু তাত্ত্বিক চর্চা হইয়াছে। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যেমনই হউক, মূল কথা থাকিয়াছে, হিন্দু ধর্মের ‘অবাধ’ সামাজিক চরিত্রটি। স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সহিতও সেই চরিত্র দিব্য মানাইয়া গিয়াছিল— ভারতীয় সংবিধানে ব্যক্তিগত ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করিবার জন্য নাগরিককে এতটাই পরিসর দেওয়া হইয়াছিল। সেই দিক দিয়া দেখিলে, সিএএ একটি ভারতীয় সভ্যতা-বিরোধী প্রস্তাব। ধর্মের নামে শিকলে বাঁধিবার প্রস্তাব। যেন একটি খোলা বারান্দা হইতে বদ্ধ ঘরে ঢুকাইবার প্রস্তাব। রাষ্ট্রের এই উৎকট দানবীয় ফন্দি সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হইবে তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy