নজরুল ইসলাম।
বাংলা কবিতা আধুনিক হয়েছে যে সব কবির মাধ্যমে বলা বাহুল্য কাজী নজরুল ইসলাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কবিতার আধুনিকতা সময়ের দিক থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্তি প্রয়াসী। সত্য-শিব-সুন্দরের পূজারি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জগৎ ও জীবনের প্রতি চরমভাবে আস্থাশীল। আধুনিক কবিরা এহেন রবীন্দ্রদর্শনকে অতিক্রম করতে চাইলেন। কাজটি বড় সহজ ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রপ্রভাবিত কাব্যজগতে তাঁরা নিজ নিজ স্বতন্ত্র কবিসত্তা গড়ে তুললেন। সকলেরই লক্ষ্য জগতের ছেঁড়াখোঁড়া বাস্তবকে কবিতায় তুলে ধরা। সেদিক থেকে নজরুল সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহ ঘোষণা করেই বাংলা কাব্যে তাঁর স্বতন্ত্র কবিবৈশিষ্ট্য গড়ে তুললেন।
বর্ধমানের চুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন নজরুল। ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের পর পর চার পুত্রের মৃত্যুর পরে নজরুলের যখন জন্ম হল, তাঁর নাম রাখা হল দুখু মিঞা। মাত্র আট বছর বয়সেই বাবাকে হারান। স্কুলে পড়াকালীনই তিনি গল্প ও কবিতা লিখতে শুরু করেন। স্কুলের পড়া শেষ না করেই কাজী নজরুল ইসলাম (২৫.০৫.১৮৯৯-২৯.৮.১৯৭৬) ৪৯ নম্বর বাঙালি রেজিমেণ্টে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে মেসোপটেমিয়ায় যান (১৯১৭)। সেখানে বাঙালি পল্টনের মুসলমান সেনাদের তদারকির কাজে এক জন পাঞ্জাবি মৌলবী যুক্ত ছিলেন। তাঁর মুখে হাফিজের কবিতা শুনেই মুগ্ধ নজরুল মৌলবী সাহেবের কাছে ফারসি শিখতে থাকেন। সৈনিক কবির প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা হাফিজের অনুসরণেই— ‘নাই বা পেল নাগাল, শুধু সৌরভেরই আশে/ অবুঝ সবুজ দূর্বা যেমন যুঁইকুঁড়িটির পাশে/ বসেই আছে— তেমনি বিভোর থাক্ রে প্রিয়ার আশায়,/ তার অলকের একটু সুবাস পশবে তোরও নাসায়।’
কবি দেশে ফিরলেন দু’বছর পরে অর্থাৎ ১৯১৯ সালে। ক্রমে সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, প্রবাসী ইত্যাদিতে কবিতা লিখে কলকাতার সাহিত্যমহলে তিনি সুপরিচিত হলেন। ১৯২২ সালে ‘বিজলী’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে তিনি আলোড়ন ফেলে দিলেন। মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে যৌথ ভাবে সম্পাদনা করলেন ‘নবযুগ’ পত্রিকা। তার পরে প্রকাশ করলেন ‘ধূমকেতু’ (১৯২২) পত্রিকা। এখানেই তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশ হলে প্রবল প্রতিবাদী সত্তার অজুহাতে তাঁকে কারারুদ্ধ করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ইতিমধ্যে তাঁর অগ্নিবীণা কাব্যটিও (১৯২২) প্রকাশিত হয়েছে।
সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েও নজরুল তাঁর সৃষ্টির কাজে অনড় থাকলেন। হুগলি জেলে বন্দিদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হলে অন্য বন্দিদের সঙ্গে নজরুলও অনশন শুরু করেন। রবীন্দ্রদর্শন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইলেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নজরুলকে বুকে টেনে নিয়েছেন। আবার রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অন্তরের আকর্ষণ অনুভব করা যায় তাঁর অগ্নিবীণা কাব্যের নামকরণটি দেখে। কারণ রবিঠাকুরের একটি গানই এর প্রেরণা— ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’। প্রাণের আবেগে ভরা তরুণ কবি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত (১৯২৩) নাটকটি উৎসর্গ করেছিলেন। অথচ নজরুল ছিলেন কল্লোলীয় কবি। যাঁদের মূল লক্ষ্যই ছিল রবীন্দ্র বিরোধিতা।
নজরুলের কবিতায় বিদ্রোহের সুর বেজে ওঠার কারণ হিসেবে সুকুমার সেন একটি যুক্তি দিয়েছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও প্রাচ্যভূমির দুর্দশা দূর হয়নি। মেসোপটেমিয়ায় গিয়ে স্বাধীনতাকামী মুসলিম রাষ্ট্র তুর্কির উদ্যম নজরুল দেখেছিলেন। সেটাই তাঁর কবিতায় ‘বিদ্রোহ-উল্লাসের সুর’ এনেছিল।
ব্যক্তিগত জীবনও বড় যন্ত্রণাময় ছিল কবির। ১৯২৪ সালে তাঁর বিয়ে হয় প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে। সস্ত্রীক হুগলিতেই বাস করতে থাকলেন। তখন থেকেই সক্রিয় ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়া। গঠিত হয় স্বরাজপার্টি তথা তাঁদের মুখপত্র ‘লাঙল’ পত্রিকা। তাঁর বিখ্যাত সাম্যবাদী কবিতার প্রকাশ তো এখানেই হয়েছিল। ইতিমধ্যে দুই পুত্রসন্তানের অকালমৃত্যু কবিকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে। অধ্যাত্ম-আশ্রয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেন। আবার ১৯৪০ সালে স্ত্রী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। ১৯৪২ সালে কবি নিজেও দুরারোগ্য পিক্সরোগে আক্রান্ত হলেন। যাতে ক্রমশ তাঁর মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা চলে যায়, তিনি সৃষ্টির দুনিয়া থেকে নির্বাসিত হন।
কাজেই আমরা বুঝতেই পারছি ৭৭ বছরের জীবন হলেও সৃষ্টির জন্য তিনি পেয়েছেন মাত্র ২২-২৩ বছর। কিন্তু এরই মধ্যে তাঁর সৃষ্টি সম্ভারের প্রাচুর্য দেখলে অবাক হতে হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, বিষের বাঁশী, ভাঙ্গার গান, ফণিমনসা, পূবের হাওয়া, চিত্তনামা, সর্বহারা, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ঝিঙ্গেফুল, সন্ধ্যা ইত্যাদি। কাব্যগ্রন্থের নামকরণের মধ্যেও প্রচলিত ধ্যানধারণার প্রতি অনাস্থা লক্ষিত হয়। তিনি হাফিজের অনুবাদও করেছিলেন—রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ নামে। রিক্তের বেদন, শিউলিমালা ইত্যাদি তাঁর গল্পগ্রন্থ। বাঁধন-হারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা তাঁর উপন্যাস। এ ছাড়া ঝিলিমিলি ও আলেয়া নামে দু’টি নাটকও রয়েছে। দুর্দিনের যাত্রী ও রুদ্রমঙ্গল নামে দু’টি প্রবন্ধের বইও আছে তাঁর।
তাঁর অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান কাব্যের কবিতাগুলিতে বিদ্রোহী সত্তার সম্যক প্রকাশ মেলে যা তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষে গভীর দেশপ্রীতিও জাগ্রত করেছিল। যেমন ‘কারার ঐ লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট/ রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী’, (ভাঙ্গার গান)। সমাজের নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তবে তাঁর এই সাম্যবাদ মার্ক্স-এঙ্গেলস প্রবর্তিত সাম্যবাদ নয়। তিনি মূলত ধনী-নির্ধন, নারী-পুরুষ ইত্যাদি বৈষম্যের পাশাপাশি জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে বলেছেন। কোনও রকম ধর্মীয় গণ্ডীতে নিজের কবিসত্তাকে বাঁধতে চাননি। তাই ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা,’ ‘আগমনী’ যেমন আছে তেমনি ‘কোরবাণী’ ও ‘মোহর্ রম্’ও আছে তাঁর লেখায়।
বিদ্রোহই শুধু তাঁর কবিতার কেন্দ্র জুড়ে অবস্থান করেনি, প্রেমও তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে। ছায়ানট বা দোলনচাঁপা কাব্যের বিষয় প্রেম ও প্রকৃতি। দোলনচাঁপা কাব্যের অভিশাপ কবিতায় প্রিয়তমাকে উদ্দেশ্য করে কবি বলছেন, ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,/ অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে/ বুঝবে সেদিন বুঝবে।’ আবার ছায়ানট কাব্যের বিজয়িনী, পলাতকা, চিরশিশু, বিদায়বেলা, দূরের বন্ধু ইত্যাদি কবিতায় প্রেমের সঙ্গে প্রকৃতিকে মিলিয়েছেন।
গান বাদ দিয়ে নজরুলের স্মৃতিতর্পণ সম্পূর্ণ হতে পারে না। সমসময়ে তাঁর গানগুলি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এটা একটা বিস্ময় যে, এত কম সময়ে তিনি প্রায় চার হাজার গান রচনা করেন। গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানির চাহিদাতেও তাঁর এই বিপুল সংখ্যক গান রচনা। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে সৃষ্ট বলে অনেক গানই পরবর্তীতে আর সংরক্ষিত হয়নি ঠিক মতো। তবে তিনি কিছু গানের সংকলন করে গিয়েছেন, গানের মালা, গুল বাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি গ্রন্থে। সুর তথা বিষয় বৈচিত্র্যে তাঁর গানগুলি বাংলা সঙ্গীত জগতের সম্পদ। বর্তমানে নজরুলগীতির তেমন আর জনপ্রিয়তা নেই বলে অনেককেই আক্ষেপ করতে শোনা যায়। অথচ তাঁর শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলীর পাশাপাশি ইসলামি সঙ্গীত, মুর্শেদী গানে মুগ্ধ হতে হয়। আজকের দিনে বেশি করে গীত হোক তাঁর সম্প্রীতি ও নারীজাগরণের গানগুলি। তা হলেই হবে আমাদের চেতনায় বিরাজিত কবি-সঙ্গীতজ্ঞ-সঙ্গীতস্রষ্টা এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিকের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
শিক্ষিকা, শ্রীপৎ সিং কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy