পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার স্মরণে প্রকাশিত ডাকটিকিট। ছবি: সংগৃহীত
১৯০৬ সাল। দাদাভাই নওরোজির সভাপতিত্বে কলকাতা শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ২২তম অধিবেশন। সেখানে এক বছর তিরিশের যুবকের দেশের প্রতি অকুণ্ঠ প্রেম ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ সকল সভ্য। তাঁদের মিলিত সমর্থনে সেই যুবককে জাতীয় কংগ্রেসের এগ্জিকিউটিভ কমিটির সদস্য করা হল। নিঃসন্দেহে খুশির দিন। কিন্তু আনন্দের সেই দিনেও যুবকটির চোখে যন্ত্রণা ও হতাশার ছবি। কারণ, জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ইউনিয়ন জ্যাকের উত্তোলন একেবারেই মেনে নিতে পারেননি সেই যুবক। তিনি স্বাধীন ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকার অন্যতম কারিগর পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া।
জাপানি বেঙ্কাইয়া, পাট্টি ভেঙ্কাইয়া, ঝাণ্ডা ভেঙ্কাইয়া— বহুমুখী প্রতিভার জন্য নানা নামে দেশবাসীর কাছে পরিচিত এই মানুষটির জীবন ছিল চঞ্চলা নদীর মতো। চিরপ্রবহমান, কর্মব্যস্ততা সঙ্গে নানা বিচিত্র কর্মকাণ্ড। ১৮৭৬ সালের ২ অগস্ট অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনমের এক অনামী গ্রামে তাঁর জন্ম। ছেলেবেলা থেকেই মেধাবী। আর্থিক সঙ্কটকে কখনও তাঁর পড়াশোনার পথে বাধা হয়ে উঠতে দেননি বাবা পিঙ্গালি হনুমন্ত রায়াডু এবং মা ভেঙ্কট রত্নাম্মা। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ছেলে যাতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে সে দিকে সব সময় নজর রেখেছেন। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মছলিপত্তনমের উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে পাঠ শেষ করে ভূতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে পড়তে সিলনে যান। সেখান থেকে মুম্বই। কিছুদিন পড়াশোনার পরে অস্ত্র চালানো শিখে যোগ দেন ইংরেজ সেনাবাহিনীতে। আফ্রিকায় তখন নতুন করে শুরু হয়েছে ইঙ্গ-আফ্রিকান ‘বোয়ের যুদ্ধ’। ভেঙ্কাইয়াকে পাঠানো হল সেই যুদ্ধে। সেখানেই গাঁধীজির সঙ্গে প্রথম পরিচয়। একই সঙ্গে চলতে লাগল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর মানবতাবাদী অহিংস ধর্মের পাঠ।
গাঁধীজীর আদর্শকে কোনও দিনই ভোলেননি তিনি। দেশে ফিরে মোটা মাইনের রেলের গার্ডের চাকরি ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাদ্রাজের প্লেগ দুর্গত মানুষজনের সাহায্যে। সঙ্গে পড়াশোনাও চলতে লাগল। মাতৃভাষা তেলুগু আর হিন্দির পাশপাশি, লাহৌরের অ্যাংলো বৈদিক কলেজ থেকে শিখে নিয়েছেন উর্দু, সংস্কৃত এবং জাপানি ভাষা। এর মধ্যে মজার হল জাপানি ভাষা শেখা। তখন ১৯০৪ সাল। রাশিয়া-জাপান যুদ্ধে জাপানের সংগ্রাম দেখে অভিভূত হয়ে ভেঙ্কাইয়া জাপানের ইতিহাস, সাধারণ মানুষের জীবন ও দর্শন সম্পর্কে জানতে শিখতে শুরু করলেন জাপানি ভাষা। এর জন্যই অনেকে তাঁকে জাপানি ভেঙ্কাইয়া ডাকতেন।
ভারতীয় কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান রয়েছে। সময়টা ১৯১৮ বা ১৯১৯। গাঁধীজীর নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দানা বাঁধছে খাদি আন্দোলন। জোর কদমে শুরু হয়েছে স্বদেশী কাপড় তৈরি ও তুলো উৎপাদনের কাজ। কিন্তু কাপড়ের জন্য যথেষ্ট উন্নতমানের কাপাস তুলো কই? সেই সময় সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে আমেরিকা থেকে কম্বোডিয়ান জাতের তুলো বীজ নিয়ে এসে ভারতীয় বীজের সঙ্গে সংকরায়ণ ঘটিয়ে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া তৈরি করলেন উন্নতমানের তুলো বীজ। পরিচিত হলেন ‘পট্টি ভেঙ্কাইয়া’ নামে। আর কৃষিক্ষেত্রে এই গবেষণার সুবাদে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকেও জুটেছিল ‘রয়্যাল সোসাইটি অব এগ্রিকালচার’-এর আজীবন সদস্যপদ।
তবে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া ব্যক্তিগত জীবনে সব থেকে বেশি পরিচিত হয়েছিলেন ‘ঝাণ্ডা ভেঙ্কাইয়া’ হিসেবেই। ১৯০৬ সালের জাতীয় কংগ্রেসের সেই অধিবেশনের পর থেকেই কংগ্রেসের প্রায় প্রত্যেকটি অধিবেশনেই তিনি নিয়ম করে প্রশ্ন তুলতেন ব্রিটিশ পতাকার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। শুধু তাই নয়, ১৯১৬ সালে দেশের নানা প্রান্ত থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বহু পরিশ্রমে বানিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের জন্য সম্ভাব্য তিরিশটি পতাকার ক্যাটালগ। কেমন ছিল ভেঙ্কাইয়ার সেই ক্যাটালগ? আসলে গাঁধীজীর আদর্শে বিশ্বাসী ভেঙ্কাইয়া চেয়েছিলেন স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের জন্য একটি ভাষা ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রতীক। আর তাই তাঁর ক্যাটালগের অধিকাংশ পতাকার নকশা তৈরি করা হয়েছিল মূলত ভাষা, ধর্ম ও আঞ্চলিক প্রতীক চিহ্নের মতো তিনটি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। দেশের প্রধান আটটি ধর্মের জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন রামধনুর অনুকরণে সমান্তরালে বিন্যস্ত আটটি পৃথক বর্ণ এবং দেশের প্রধান, অপ্রধান উনিশটি ভাষার জন্য উনিশটি পাঁচ বাহু বিশিষ্ট তারা। বিভিন্ন ধর্মের জন্য বিভিন্ন রং ও চিহ্ন স্থির করা ছিল। সঙ্গে ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয় পদ্মফুল, ময়ূর, তীর-ধনুক, লাঙল, কৈলাস পর্বতের মতো নানা প্রতীক চিহ্ন। এর পাশাপাশি, তিনি স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন জাতীয় উৎসবের জন্যও তৈরি করেছিলেন বিশেষ কয়েকটি ধরনের পতাকার নকশা।
১৯২১ সালে বিজয়ওয়াড়ায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে এই কাজে মুগ্ধ হয়ে গাঁধীজী তাঁকেই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে স্বরাজ পতাকার নকশা তৈরির পরামর্শ দেন। সঙ্গে ত্রিবর্ণশোভিত সেই পতাকার রূপরেখা। ১৯২৩ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শুরু হওয়া অন্দোলনে প্রথম বারের জন্য উত্তোলিত হয় ভেঙ্কাইয়ার সেই পতাকা। লাল, সাদা ও সবুজ বর্ণে শোভিত সেই পতাকার কেন্দ্রে ছিল ভারতের স্বনির্ভরতার অন্যতম প্রতীক চরকা। স্বাধীনতার সময়ে যখন জাতীয় পতাকা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হল তখন পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার তৈরি পতাকাকেই ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছিল। জওহরলাল নেহরু, সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণণ, অম্বেডকরের মতো ব্যক্তিরা অনেক অলোচনার পরে স্থির করেছিলেন জাতীয় পতাকায় লাল রঙের পরিবর্তে ব্যবহার করা হবে গেরুয়া। আর চরকার জায়গায় স্থান পেয়েছিল অশোকচক্র।
বিজয়পুর পলসোনা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy