নরেন্দ্র মোদী।—ছবি পিটিআই।
টেলিভিশনের পর্দা জুড়িয়া যখন তিনি জাতির উদ্দেশে ঘোষণা করিলেন যে অতঃপর ৫০০ এবং ১,০০০ টাকার নোট বাতিল; তাহার সাড়ে আট মাস পর এক মধ্যরাতে সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল হল আলো করিয়া যখন তিনি জানাইলেন যে পণ্য ও পরিষেবা কর চালু হইয়া গেল— তখনও ২০১৯ সালের ডিসেম্বর দূর অস্ত্। তিনি কেন নোট বাতিল করিয়াছিলেন, কেনই বা অর্ধপক্ব জিএসটি-কে চাপাইয়া দিয়াছিলেন ভারতীয় অর্থব্যবস্থার ঘাড়ে, নরেন্দ্র মোদী এখনও বলেন নাই। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার কোমর ভাঙিয়া দেওয়াই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল, বলিলে হয়তো তাঁহার প্রতি কিঞ্চিৎ অন্যায় হইবে। কিন্তু, শুধু কোমর নহে, অর্থনীতির সর্বাঙ্গে ক্ষতচিহ্ন তৈরি করিয়াছেন তিনি। জিডিপি-র বৃদ্ধির হার সাড়ে চার শতাংশে নামিয়া আসা তাঁহারই কর্মফল। বিপদ যে অনিবার্য, অর্থনীতিবিদরা ২০১৬ সালেও বলিয়াছিলেন, ২০১৭ সালেও। নরেন্দ্র মোদী কানে তোলেন নাই, ভাবিয়াছেন— তাঁহার বিরোধিতা করিতেই বুঝি সর্বনাশের ভবিষ্যদ্বাণী করিতেছেন পণ্ডিতেরা। তাই তিনি থামেন নাই। তাই ২০১৯ সালেও তিনি ও তাঁহারা পরিসংখ্যান লুকাইয়াছেন, প্রসিদ্ধ অর্থশাস্ত্রীদের মুখে ঝামা ঘষিতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের মাঠে নামাইয়াছেন। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে কার্যত বাধ্য করিয়াছেন সরকারের হাতে উদ্বৃত্ত মুনাফা তুলিয়া দিতে। আর্থিক বৃদ্ধির হারকে চাঙ্গা করিতে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির পরিবর্তে কর ছাড় দিয়াছেন কর্পোরেট ক্ষেত্রকে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচিয়া রাজকোষ ঘাটতি মিটাইবার পরিকল্পনা করিয়াছেন। অর্থাৎ, তিন বৎসর পূর্বের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিবার কোনও চেষ্টা নরেন্দ্র মোদী ২০১৯ সালের মন্দার মুখে দাঁড়াইয়াও করেন নাই। ফল— আর্থিক বৃদ্ধির হার তলানিতে, কর্মসংস্থানহীনতা চরমে, এবং খুচরা পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেলাগাম। সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রধানমন্ত্রী জানাইয়াছেন, সব ঠিক হইয়া যাইবে।
আশ্বস্ত করিবার কাজটি অবশ্য তাঁহারা বৎসরভর করিয়াছেন। কখনও নির্মলা সীতারামন কঠিন ভঙ্গিতে জানাইয়াছেন যে কোনও চিন্তা নাই, কখনও নরেন্দ্র মোদী বলিয়াছেন, অ্যানিম্যাল স্পিরিট জাগিয়া উঠিলেই, ব্যস, চিন্তা থাকিবে না। তাঁহারা অর্থশাস্ত্রের কেতাব ঘাঁটিয়া মন্দার সংজ্ঞা দেখাইয়া দিয়াছেন, বলিয়াছেন— ভারতে এখনও সেই অবস্থা হয় নাই। কখনও সিনেমার দর্শকসংখ্যার পরিসংখ্যানে বুঝাইয়াছেন অর্থনীতি চাঙ্গা আছে, কখনও নবীন প্রজন্মের অ্যাপ ক্যাবে চড়িবার প্রবণতাকে দোষ দিয়াছেন। এবং, অতি অবশ্যই, পরিসংখ্যান গোপন করিয়াছেন। এমনই তীব্রতায় যে ভারতীয় পরিসংখ্যানের গ্রহণযোগ্যতা লইয়াই দুনিয়াভর প্রশ্ন উঠিয়াছে। সেই প্রশ্নে অবশ্য তাঁহারা কান দেন নাই, কারণ তাঁহারা জানেন, রঘুরাম রাজন হইতে অমর্ত্য সেন বা অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি সরকারের আর্থিক নীতির সমালোচনা করেন, তিনিই শত্রু। প্রধানমন্ত্রীর বরাভয়ও যখন ভরসা দেয় নাই, অর্থমন্ত্রীর কঠিন চোয়ালও যখন লোককে সাহস দিতে ব্যর্থ হইয়াছে, তখন ভরসা ছাড়িয়া ভয়ের পথে হাঁটিলেন তাঁহারা। রাহুল বজাজের উদাহরণটি স্মর্তব্য। সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলিলে কী হেনস্থা হয়, কর্তারা তাহাতে কোনও সংশয় রাখেন নাই। মনমোহন সিংহ আদি পণ্ডিতেরা বলিয়াছেন বটে যে এই ভয়, এই অস্বচ্ছতা ভারতীয় অর্থনীতির মস্ত ক্ষতি করিতেছে, কিন্তু তাহাতে কী? মনমোহন সিংহ অর্থনীতিজ্ঞ হইতে পারেন, কিন্তু শত্রু তো বটে। এবং, বৎসরের শেষ বেলায় আসিয়া অন্য শত্রুনিধনযজ্ঞে অর্থনীতির প্রশ্নটিকেই তাঁহারা ভুলাইয়া দিতে সক্ষম হইয়াছেন। গীতা গোপীনাথ রাখঢাক না করিয়াই বলিয়াছেন, অর্থনীতির হাঁড়ির হাল গোপন করিতে নাগরিকত্ব বিল লইয়া ধুন্ধুমার অতি চমৎকার পন্থা। ডিটেনশন ক্যাম্পের আশঙ্কা প্রকট হইলে কি আর পেঁয়াজের দামের কথা ভাবিবার অবকাশ থাকে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy