সেটে আমি বাঙালি। ডিওপি রবি কিরণ আইয়াগিরি তেলুগু। বিনীত উত্তরপ্রদেশের, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের দায়িত্বে থাকা অস্কারজয়ী সুরকার রসূল পুকুট্টি কেরলের, শান্তনুদা (মৈত্র) বাঙালি হলেও দিল্লির বাসিন্দা। গোটা দেশই যেন সেটে হাজির ছিল। নিজেকে প্রথম বার ভারতীয় মনে হল”— কথাগুলো জাতীয় পুরস্কারজয়ী চিত্র পরিচালক সুমন ঘোষের। অনুষঙ্গ ভারতীয় নাগরিকত্বের অন্যতম স্বীকৃতি (?) আধার কার্ডের মতো একটা সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে বানানো ছবি ‘আধার’এর নির্মাণ।
প্রশ্ন হল, এ কথা বলার আগে কি পরিচালকের মধ্যে ভারতীয়ত্বের কোনও সেন্টিমেন্ট ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। আর ছিল বলেই এমন একটি সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে ছবি করার চিন্তা উঠে এল তাঁর মাথায়। যেখানে আধার কার্ড বানাতে এক জন হতদরিদ্র কৃষকের আঙুলের ছাপ স্পষ্ট হয় না। কারণ মাঠে কাজ করতে করতে হাতের আঙুল তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে।
তা হলে কেন তিনি বললেন এমন কথা? উত্তর পেতে পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। বলিউডের সেটে ভারতের বহুত্ববাদ তার উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে দশকের পর দশক জুড়ে হাতে হাত রেখে যে উৎকর্ষের সাধনার ব্যতিক্রমী নজির রেখে চলেছে দেশ তথা বিশ্বের কাছে, তাকে কুর্নিশ করেই সুমনের এই সগর্ব উক্তি। তাই বলিউডকে বলা হয় এক মিনি ভারত।
প্রশ্ন হল, এই সহাবস্থানের সাধনার জন্য কি ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’-এর মতো এক দেশ এক ভাষার জিগির তোলার দরকার আছে?
দুর্ভাগ্য, কারও কারও দরকার হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। এবং হচ্ছে খুব ঔদ্ধত্যের সঙ্গে। ক্ষমতার দম্ভকে সঙ্গে নিয়ে। বিবিধের সমন্বয়বাদী ভারতীয় ঐতিহ্যকে চূর্ণ করে। ‘নানা ভাষা না মত’-এর সহাবস্থানের সাংস্কৃতিক ধারা ও তার সাংবিধানিক রক্ষাকবচকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় হিন্দি দিবসে যা বললেন, তার মর্মার্থ হল— এক দেশ এক ভাষার পক্ষে জোরালো সওয়াল। সে ভাষা হিন্দি। হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার এই প্রবণতা অবশ্যই নতুন নয়। শুধু সংখ্যার জোর দেখিয়ে একটি ভাষাকে অহিন্দিভাষী অবশিষ্ট ভারতের উপর চাপিয়ে দেওয়ার এই ঘৃণ্য রাজনীতি স্বাধীনতার আগে থেকেই এ ভারত দেখে আসছে। সেই যে ১৮৩০-এ গো-বলয়ের হিন্দু আধিপত্যের চাপে প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতের প্রশাসনিক ভাষা উর্দু-ফার্সিকে সরিয়ে ব্রিটিশ হিন্দির প্রতি নরম মনোভাব দেখাল, তাকেই ফের ১৯০৫-এ এসে উসকে দিলেন বালগঙ্গাধর তিলক। প্রতিবাদ প্রতিরোধও কম হয়নি। কিন্তু এ অপচেষ্টা অব্যাহত। আজকাল একটু বেশি মাত্রায়।
কিছু দিন আগেই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৯-এর খসড়া তৈরি হল এই অপচেষ্টাকে মাথায় রেখেই। দেওয়া হল দেশের সমস্ত স্কুলে হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার স্বেচ্ছাচারী প্রস্তাব। হিন্দি বলয় ছাড়া অবশিষ্ট ভারত, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারত, স্বভাবতই গর্জে উঠছিল। নেহাত চাপে পড়েই জাতীয় শিক্ষা নীতির খসড়া সংশোধন করল কেন্দ্র।
কিন্তু মনের খিদে রুখবে কে? সে তো অবচেতনের আকর। স্বেচ্ছাচারী ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের ডিএনএ। এত সহজে কি তা আত্মস্থ হয়? যথারীতি হয়নি। আর হয়নি বলেই এত প্রতিবাদ, এত প্রতিরোধেও সে মরেনি। সাত দশক ধরে রাজা এসেছে, রাজা গিয়েছে। কিন্তু স্বেচ্ছাচারের বিকৃতি রয়েই গিয়েছে স্বমহিমায়।
এই বিকৃতিকে রুখে দিতে যে প্রতিবাদ, তাতে এগিয়ে থেকেছে তামিলনাড়ু। স্বাধীনতার আগে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০। ১৯৩৭-এ দু’জন শহিদ ও ১১৯৮ জন গ্রেফতার। স্বাধীনতার পর ১৯৬৫-তে কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত। ওই বছর ২৬ জানুয়ারি হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা ঘোষণার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে আগের দিন ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন মাদ্রাজে প্রাণ দিলেন বেশ কিছু তামিল।
শুধু হিন্দি নয়, একটি আঞ্চলিক ভাষার আধিপত্য কায়েম করতে অন্য একটি আঞ্চলিক ভাষাকে খর্ব করার হীন রাজনীতিও তৈরি করেছে ভাষা সন্ত্রাস। বলি হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এই ভাষা সন্ত্রাসের সব চেয়ে বড় শিকার বাংলাভাষী মানুষ। অসমে বাংলাকে গায়ের জোরে সরিয়ে অসমিয়াকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার বিরুদ্ধে ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচরে ভাষার জন্য শহিদ হলেন ১২ জন বাঙালি। তার পরেও স্বাধীন ভারতের মাটিতে সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে ভাবে অসমে শুধু ভাষা বৈরিতাকে সঙ্গে নিয়ে ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে, একের পর এক ঘটেছে বাঙালি নিধনযজ্ঞ, তাতে শুধু বাঙালি হিসেবেই নয়, যে কোনও ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক জন ভারতীয় হিসেবে মনে প্রশ্ন জাগে, এর শেষ কোথায়? তীব্র ক্ষোভ আর আক্ষেপ হয়, যখন দেখি এই ভাষা-বিদ্বেষকেই হাতিয়ার করে অসমীয়া আর বাঙালির মধ্যে আরও বৈরিতা বৃদ্ধিতে ইন্ধন দেওয়া হয়। এমনকী, স্রেফ ভোটের সমীকরণ মাথায় রেখে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকেও নিপুণ ভাবে কাজে লাগানো হয়। যেহেতু একটা বিরাট সংখ্যক বাংলাভাষী মানুষ মুসলমান। অথচ, ধর্ম নয়, ভাষা-বিদ্বেষই যে ভিতরের সত্য, তা ইতিমধ্যেই এনআরসি’র চূড়ান্ত খসড়া থেকে ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে বেশির ভাগ বাংলাভাষী (হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে) হওয়াই তার প্রমাণ। তিনসুকিয়ার হতদরিদ্র বাংলাভাষীদের নির্বিচারে হত্যা বাঙালির উপর ভাষা-সন্ত্রাসের সাম্প্রতিকতম সংযোজন। কবি শ্রীজাতকে নিগ্রহ, গায়ক শানের সঙ্গে অভব্য আচরণ—এ সব তো আছেই। মনে পড়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেও বাধ্য করার অপচেষ্টা হয়েছিল অনুষ্ঠানের প্রথম গান অসমিয়ায় গাইতে। ভূপেন হাজারিকার হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় রক্ষে হয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাঙালি কেন বার বার এই ভাষা-সন্ত্রাসের শিকার? উত্তর সহজ। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দির পরেই যে ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা বেশি, তা হল বাংলা। অর্থাৎ সংখ্যার নিরিখে হিন্দির নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলা। কিন্তু সেই ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই সাংস্কৃতিক কৌলিন্যে হিন্দি তো বটেই, অবশিষ্ট ভারতের চেয়ে সে এগিয়ে। গোখেলের সেই প্রবাদ হয়ে যাওয়া কথাটা, “হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া উইল থিঙ্ক টুমরো” তো আর শুধু কথার কথা ছিল না। সাহিত্যে এশিয়ার প্রথম নোবেল বাংলায়, সিনেমায় উপমহাদেশে প্রথম অস্কার বাংলায়। স্বাধীনতার আগে থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে তো বটেই, এমনকি মিনি ভারত বলিউডেও বাঙালির আধিপত্য। ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানীর তকমা কলকাতার।
আর ভাষাই যেহেতু ভাব তথা সংস্কৃতির বাহন, তাই ভাষা আক্রান্ত বার বার। কোনও জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি হয় একটা বহতা নদী, তো ভাষা হল সে নদীর জল। স্বভাবতই সেই জল যদি শুকিয়ে যায়, তা হলে নদীটাই আর থাকে না।
শক্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy