Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Ebrahim Raisi

নামভূমিকায়: ইব্রাহিম রইসি

দেশে দেশে যুদ্ধ লাগাতে শীর্ষনেতাদের দায়িত্ব কম নয়। এই মুহূর্তে ইজ়রায়েল-বিরোধী আক্রমণ তীব্র করতে চান ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি

সৌরজিৎ দাস
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:১৮
Share: Save:

ইরান আর ইজ়রায়েলের যে ‘যুদ্ধ’ হচ্ছে এখন, তাতে দুই দেশেরই প্রধান নেতার ভূমিকা গুরুতর। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কথা বহু-আলোচিত। তুলনায় কম পরিচিত মুখ ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি। তাঁর প্রধান পরিচয় কিন্তু আগ্রাসী নেতা হিসাবেই। সম্প্রতি পাকিস্তানে গিয়ে ইজ়রায়েলের প্রতি আরও কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে এসেছেন রইসি। ফলে অনেকেরই ধারণা, ইজ়রায়েলে আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে আরও নতুন কৌশল নিতে উদ্যোগী তিনি। কিন্তু কে এই রইসি?

১৯৮৮। রইসি তখন তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর পদে আসীন। ওই পদে থাকাকালীন ‘ডেথ কমিটি’ নামে এক বিতর্কিত গোপন ট্রাইব্যুনাল-এর চার জন বিচারকের অন্যতম। ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন টালমাটাল। হাজার হাজার মানুষ জেলবন্দি। এঁদের পুনর্বিচারের ব্যবস্থা হয়েছিল এই ট্রাইব্যুনালেই। বন্দিরা অনেকেই ছিলেন সরকার-বিরোধী বামপন্থী দল মুজাহিদিন-ই-খাল্‌ক’এর সদস্য। ট্রাইব্যুনালে ঠিক কত জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, আজও তা অজানা। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলির দাবি, অন্তত পাঁচ হাজার মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়।

পরবর্তী কালে এই সব মৃত্যুদণ্ডের পিছনে নিজের ভূমিকার কথা বারংবার অস্বীকার করেছেন রইসি, যদিও সঙ্গে এও বলেছেন যে, সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা খোমেনির ফতোয়ার কারণে মৃত্যুগুলি ন্যায়সঙ্গত ছিল। শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, শোনা যায়, যখনই কোনও কাজ নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সম্পন্ন করার প্রয়োজন হত, খোমেনি-র কাছ থেকে ডাক পড়ত তাঁর।

১৯৬০ সালে ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশাদ-এ, যেখানে শিয়া মুসলিমদের পবিত্র মাজার অবস্থিত, জন্ম হয় রইসির। তাঁর পিতাও ছিলেন এক ধর্মীয় নেতা, যাঁকে শৈশবেই হারান তিনি। পনেরো বছর বয়সে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে অম শহরের এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শুরু করেন পড়াশোনা। লক্ষণীয়, অম-এর শিক্ষালয়গুলি সেই সময় ছিল শাহ-বিরোধী আন্দোলনের আখড়া। অনেক শিক্ষার্থীই পথপ্রদর্শক এবং অনুপ্রেরণা দানকারী হিসাবে নির্বাসিত নেতা আয়াতোল্লা খোমেনিকে অনুসরণ করত। রইসিও সেই পথই নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে পশ্চিম-সমর্থিত শাহের পতন ঘটে খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামি বিপ্লবের জেরে। ওই সময়ে রইসি যুক্ত হন মৌলবাদী গোষ্ঠী হকানি বৃত্তের সঙ্গে। এই গোষ্ঠীর সদস্যদের অনেকেই পরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হন, যেগুলি মূলত ছিল দমনমূলক প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৯ সালের ওই বিপ্লবের পরে রইসিও বিচার বিভাগে যোগ দেন এবং বিভিন্ন শহরে প্রসিকিউটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৯ সালে খোমেনির মৃত্যুর পরে আয়াতোল্লা আলি খামেনেই যখন দেশের সর্বোচ্চ নেতা হন, তখন তিনিও বিভিন্ন কাজে রইসিকে যুক্ত করেন। তাঁর সময়েও বিভিন্ন পদোন্নতির মাধ্যমে রইসিকে বিচারবিভাগের উপপ্রধান এবং ২০১৪ সালে দেশের প্রসিকিউটর জেনারেল পদে নিযুক্ত করা হয়। এর বছর দুয়েক পরে ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ‘আস্তান-ই-কুদস’এর রক্ষক হিসাবে রইসির নিয়োগে সকলের কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, খামেনেই তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে রইসিকেই তৈরি করছেন। এর ফলে রইসির যেমন এক মহৎ ভাবমূর্তি তৈরি হয়, তেমনই তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষমতাও প্রতিষ্ঠা পায়। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াইয়ে প্রার্থী হিসাবে যোগ দিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে না পারলেও, ওই পরাজয়ে তাঁর ভাবমূর্তির কোনও ক্ষতি হয়নি। বরং বছর দুয়েকের মধ্যে খামেনেই তাঁকে ইরানের বিচার বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দেন। সেখানে রইসি বেশ কিছু সংস্কার কর্মসূচি পরিচালনা করেন, যার ফলে হ্রাস পায় মাদক সংক্রান্ত অপরাধের কারণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সংখ্যা। তার পরেও অবশ্য চিন ছাড়া ইরানেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। শুধু তা-ই নয়, গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে বহু মানুষের বিরুদ্ধে বিচারকার্য অব্যাহত রেখেছে বিচারবিভাগ।

এ দিকে, রইসির বিরুদ্ধে মানবাধিকার রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করে ২০১৯ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পাশাপাশি ২০০৯ সালের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর সরকার-বিরোধী গ্রিন মুভমেন্ট আন্দোলন হিংসাত্মক উপায়ে দমন করার অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। যদিও এর কোনও কিছুই তাঁকে ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়া থেকে আটকাতে পারেনি। ভুললে চলবে না, এই নির্বাচনেই বেশ কয়েক জন মধ্য ও সংস্কারপন্থী প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল, যার ফলে অভিযোগ ওঠে, সব কিছু এমন ভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে রইসিকে নির্বাচনে বড় ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীনই হতে হয়নি।

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাদের সমস্যা হল, তাঁরা চিরকালই জনসাধারণের উপরে বলপ্রয়োগ করে এসেছেন, ফলে সময়ের সঙ্গে রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে দূরত্ব। যেমন, রইসির আমলেই হিজাব বিতর্কে নীতি পুলিশের হাতে ২২ বছরের মাশা আমিনি নামক যুবতীর মৃত্যু জনসাধারণকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে লিপ্ত করে, যা আজও অব্যাহত।

এই দশকব্যাপী অশান্তির মাঝে ইজ়রায়েল-হামাসের যুদ্ধ অস্বস্তি বাড়ায় তেহরানের। আর এই মুহূর্তে ইজ়রায়েল-ইরানের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা-প্রতিহামলা যে ইরানি মানুষকে, এবং পশ্চিম এশিয়াকে মহাবিপন্ন করে তুলেছে, তার মহাসারথি রইসির মতো ক্ষমতান্ধ নেতারাই।

অন্য বিষয়গুলি:

Iran
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy