দাউদাউ করে জ্বলছে ট্রেন, বাস, টায়ার। অবরুদ্ধ রেলপথ, সড়কপথ। কর্মের দায় কোনও মতে চুকিয়ে আশঙ্কার পাহাড় ডিঙিয়ে পরের দিন ভোররাতে আতঙ্কিত নিত্যযাত্রীদের টলমল শরীরে ঘরে ফেরা। ভারতে বসবাসকারী একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের হৃদয়ও নিশ্চিত ভাবে জ্বলছে নাগরিক অস্তিত্বের সঙ্কটে। কিন্তু জ্বলন্ত ট্রেন, বাস, টায়ারের আগুনের লেলিহান শিখায় কি আদৌ জুড়োনো গেল অস্তিত্বের সঙ্কটে জ্বলতে থাকা আশঙ্কার প্রহরগুলোকে? অথচ যিনি বিপুল কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে প্রাণ হাতে নিয়ে কোনওক্রমে ঘরে ফিরলেন, সেই ধর্মনিরপেক্ষ মানুষটিরও তো শামিল হওয়ার কথা ছিল ধর্মের ভিত্তিতে এই বৈষম্যের প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের মিছিলে! কিন্তু তাঁকে তো শামিল করা গেল না সেই প্রতিবাদ মুখর দ্বিপ্রহরে!
ভারতীয় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ভারতবর্ষের পার্লামেন্টে পাশ হওয়ার পর থেকেই যে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গ এবং সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতকে অস্থির করে তুলেছে তা সকল ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রপ্রিয় মননকেই আরও অধিকতর সঙ্কটময় পরিস্থিতির আশঙ্কায় দিবানিশি উদ্বেলিত করে রেখেছে। কোনও সন্দেহ নেই যে, সিএএ, ২০১৯ একটি বিশেষ ধর্মালম্বী গোষ্ঠীকে নাগরিক অস্তিত্ব সঙ্কটের চরম আশঙ্কায় আতঙ্কিত করে তুলেছে। সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই আইন ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ প্রদত্ত মানুষের সাম্যের অধিকারকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সদ্য পার্লামেন্টে পাশ হওয়া সিএএ অনেক যুক্তিগ্রাহ্য প্রশ্নকেও এক জায়গায় জড়ো করে দিয়েছে। কেনই বা কেবলমাত্র তিনটি পড়শি দেশ থেকে শুধুমাত্র ধর্মীয় নিপীড়নের ফলে আগত ছয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বিশেষ ছাড়ের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে, তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কিন্তু অজানাই থেকে গেল! আর এই উৎপাটিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ইহুদিরা যে কেন বাদ থেকে গেল, সেই প্রশ্নটাও কিন্তু উত্তরবিহীন হয়েই রইল। কেনই বা চিন দেশ থেকে আগত সংখ্যালঘু তিব্বতি বৌদ্ধ বা শ্রীলঙ্কা থেকে আগত সংখ্যালঘু হিন্দুরা নাগরিকত্বের প্রশ্নে এই বিশেষ ছাড় পাবেন না, সে কথাও কিন্তু গোপনই রয়ে গেল! একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কেনই বা শুধুমাত্র ধর্মীয় সত্ত্বার ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান শিথিল করা হবে, সেই সম্পর্কে বিস্তর প্রশ্নমালার জাল ছড়িয়ে রেখে দিল। এই সকল উত্তরবিহীন প্রশ্নমালা এবং নাগরিকত্বের অস্তিত্বের সঙ্কটের আশঙ্কার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রেল ও সড়ক অবরোধ ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
কিন্তু প্রশ্নটা হল, আন্দোলনের নামে এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড কি আদৌ আলোর দিশা দেখাতে সমর্থ হবে? আন্দোলনকারীদের এ কথা আবশ্যিক ভাবে মাথায় রাখা উচিত যে, তাঁদের এই আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের দায় যেন কোনও ভাবেই চোকাতে না হয় তাঁদেরই সমগ্র আতঙ্কিত জনগোষ্ঠীকে। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এই হঠকারী আন্দোলনে শামিল হওয়ার সময় আন্দোলনকারীদের চিন্তাধারায় এই বিষয়গুলো কি আনা উচিত ছিল না যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও সরকার পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দল এবং একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাকি সব বিরোধী দলগুলোও একযোগে এনআরসি এবং সিএএ-এর বিরুদ্ধাচারণ করে আসছে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশও এই বৈষম্যমূলক আইনকে কোনও মতেই সমর্থন করছেন না। বঙ্গের বেশিরভাগ সৃষ্টিশীল মানুষেরাও সিএএ-এর বিপক্ষেই মত দিয়েছেন। সেইসঙ্গে এ কথাও বিবেচনার মধ্যে আনা উচিত যে, সিএএ-এর সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে দেশের শীর্ষ আদালতে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ কথা বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হবে যে, ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ ভারতে বসবাসকারী সকল মানুষকেই সাম্যের অধিকার প্রদান করেছে। তাই ভারতীয় সংবিধানের নিরাপত্তার বর্মে আচ্ছাদিত এই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ যতটা সংখ্যাগুরুদের, ততটাই সংখ্যালঘুদেরও। সুতরাং, ভারতীয় সংবিধানের মর্যাদা অটুট রাখতে সর্বস্তরের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে সঙ্গে নিয়েই গড়ে তোলা প্রয়োজন সর্বাত্মক একটি আন্দোলন।
কোন সন্দেহ নেই যে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ভারতবর্ষের ক্ষমতার মসনদে বসার পর থেকেই ভারতে বসবাসকারী একটি বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্বকে বার বার শঙ্কিত করে তুলেছে। তা সে গোমাতা রক্ষার্থের প্রশ্নেই হোক, বা গণধোলাইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে হোক, অথবা নাগরিকত্বের অস্তিত্বের আশঙ্কার প্রেক্ষিতেই হোক। এ কথাও আজ ‘ওপেন-সিক্রেট’ যে, দ্বিজাতি তত্ত্বে দ্বিখণ্ডিত ভারতবর্ষকে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের রাষ্ট্র বানানো সেই রাজনৈতিক দলের গোপন মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কথা বিশেষ ভাবে বিবেচনার মধ্যে রাখা উচিত যে, ভারতরাষ্ট্রের মজ্জার অন্তঃস্থলে নাগরিক সমাজের দৃঢ় ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রবাহ এখনও বয়ে চলেছে। ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ আজও কিন্তু মনেপ্রাণে বয়ে নিয়ে চলেছে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে প্রতিচ্ছবি। নইলে বিভিন্ন সংখ্যাগুরু আধিক্যপূর্ণ রাজ্যের রাজসিংহাসন থেকে সেই রাজনৈতিক দলকে গদিচ্যুত করা কি আদৌ সম্ভব হত? ক্ষমতাসীন সরকারের বৈষম্যমূলক ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে সংগঠিত করতে হবে সচেতন সমগ্র নাগরিক সমাজটাকেই। তাই ভারতের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের এই সঙ্কটকে শুধুমাত্র একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সঙ্কট বলে মনে করে এমন বিধ্বংসী আন্দোলন আসলে মূল সমস্যা থেকে সরে গিয়ে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার মতো বোকামি আদতে সমগ্র ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলবে। ফলে এমন বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়নকে যথাযথ ভাবে প্রতিহত করার তাগিদে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু নির্বিশেষে সমগ্র নাগরিক সমাজকেই এক সুত্রে বাঁধতে হবে। তবেই বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ আন্দোলনের আলোর আভায় বিলীন হতে পারে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অস্তিত্ব সঙ্কটের কালো রাত্রির ছায়া।
এই ধ্বংসাত্মক আন্দোলনকে সঠিক সময় কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাথমিক নরম মনোভাবও কিন্তু এই হঠকারী আন্দোলনকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে বিস্তারিত করার ক্ষেত্রে অনেকটাই অক্সিজেন জুগিয়েছে বলে মনে হওয়াটা কিন্তু একেবারেই অমূলক নয়।
কী অদ্ভুত খেলার সাক্ষ্য বহন করার দায় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ভারতবাসীকে! কোনও রাজনৈতিক দল চাইছে সংখ্যাগুরুকে চটিয়ে দিয়ে ভোটবাক্স ভরপুর করতে, আবার অন্য কোনও রাজনৈতিক দল চাইছে যে কোনও মূল্যে সংখ্যালঘুকে না চটিয়ে ভোটবাক্স অটুট রাখতে। আর এই বিপরীতমুখী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে ভোটবাক্সের চক্রব্যূহে ঘুরে মরছে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু- সহ অগণিত আমজনতা। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ভারতের আমজনতা যতটা না ‘সন্তান মোর মার’, তার থেকেও তাঁরা অনেক বেশি দামী ‘ভোটার’ নামক সরল পাটিগণিতের অংশ হিসেবে। তাই এখন শুধু একটাই প্রতীক্ষা... কে এনে দেবে ‘শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়’!
শিক্ষক, বেলডাঙা
এসআরএফ কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy